মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত প্রায় ২৮ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করতে ২০২০ সালে উদ্যোগ নেয় সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুক্তি, এগুলো অনেক পুরোনো, অপ্রচলিত এবং যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অকার্যকর। তবে এই উদ্যোগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে রিট হলে আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রিটের নিষ্পত্তি হয়নি।
আবার ঢাকায় পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে গত চার দশকে উচ্চ আদালতে যত মামলা হয়েছে, বেশির ভাগের রায় সরকারের বিপক্ষে গেছে। অবশ্য মামলাগুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এই সুযোগে বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলে রেখেছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তারা মামলাকে গুরুত্ব দেন না। অনেক সময় সরকারের বিপক্ষে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তারা যোগসাজশ করেন। অনেক সময় তাঁরা আইনকানুন বোঝেন নাফাওজুল কবির খান, সাবেক বিদ্যুৎ–সচিব
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘উচ্চ আদালতে চলমান সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনা কার্যক্রম পরিবীক্ষণ সংক্রান্ত’ কমিটির বৈঠকে সরকারি মামলা নিয়ে আলোচনা হয়। আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির ওই সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন সভাপতিত্ব করেন। এর আগে ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। তিন মাস পর পর এই কমিটির সভা হওয়ার কথা থাকলেও দুই বছর পর সভা হলো। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন কমিটির সভা হয়নি। অবশ্য ১৫ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে তিন মাস পর এই কমিটির সভা করার নির্দেশ দেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য বলছে, উচ্চ আদালতে চলমান সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট সবচেয়ে বেশি মামলা আছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে, ১৩ হাজার ৮৪৮টি। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৫৮টি এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ মামলা রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগে, ৬ হাজার ৯৮৯টি। এ ছাড়া জননিরাপত্তা ও অর্থ বিভাগ, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিস এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে মামলা আছে।
সরকার কেন মামলায় হেরে যাচ্ছে, এ বিষয়ে কথা হয় মাঠ প্রশাসনের এক কর্মকর্তা ও সাবেক এক সচিবের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, যেসব মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাদের মামলায় জেতার সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তাদের গাফিলতি ও দক্ষতার অভাব রয়েছে। আদালতে যেসব তথ্য–উপাত্ত সরবরাহ করা হয়, তা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্তের অভাবে মামলায় হেরে যায় সরকারপক্ষ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য বলছে, উচ্চ আদালতে সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এমন অনিষ্পন্ন ৮৬ হাজার ৭২৩টি মামলা রয়েছে। কেউ পদোন্নতি না পেয়ে, কেউ জমির মালিকানা পেতে, কেউ আবাসন প্রকল্পে, কেউবা ক্ষতিপূরণ পেতে মামলা করেছেন।
উপজেলা পরিষদ আইনসংক্রান্ত রিটটি হয় ২০২০ সালে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন, উপজেলা পরিষদ আইনের এমন বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বাতিল ঘোষণা করে গত ২৯ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট।
যদিও ৫ এপ্রিল হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। ৫ জুন পর্যন্ত এ রায় স্থগিত থাকবে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত, সিআরপিসির কয়েকটি ধারা, গাড়িসুবিধা নগদায়ন নীতিমালা, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের আবাসন প্রকল্পসহ অনেক মামলা আদালতে দিনের পর দিন ঝুলছে।
এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় অতীতে এমনও দেখা গেছে, পুরো ফাইল গায়েব হয়ে গেছে বা ফাইল থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ফেলে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে মামলা সরকারের বিপক্ষে যাচ্ছে।
ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখন প্রতিটি মামলা পর্যালোচনা করছি। মামলায় হেরে গেলে আপিল করছি। প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ দিচ্ছি।’
গত ১৫ ফেব্রুয়ারির সভায় উপস্থিত প্রায় সব কর্মকর্তাই প্রশ্ন তুলেছেন, স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় সরকার হারে কেন? সভায় উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, এতে সরকারপক্ষের কোনো ব্যর্থতা আছে কি না কিংবা কী কারণে মামলায় সরকার হারল, তার কারণ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
সভায় উপস্থিত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অনেক সময় মামলাসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যথাসময়ে পাওয়া যায় না। অসাধু কর্মচারীরা মামলার তথ্য–উপাত্ত ধামাচাপা দেন।
সভায় সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট তথ্য–উপাত্ত সরবরাহে প্রয়োজনে বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় বলা হয়, পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে বেশির ভাগ মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে মূল্যবান পরিত্যক্ত সম্পত্তিসংক্রান্ত ৫৯টি মামলাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মামলা সরকারের বিপক্ষে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক বিদ্যুৎ–সচিব ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তারা মামলাকে গুরুত্ব দেন না।
অনেক সময় সরকারের বিপক্ষে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তারা যোগসাজশ করেন। অনেক সময় তাঁরা আইনকানুন বোঝেন না। তা ছাড়া বর্তমান আইনে অনেক দুর্বলতা ও ফাঁকফোকর আছে। এসব কারণে মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে যায়।