কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। অথচ উৎপাদন হচ্ছে ৩ হাজার মেগাওয়াটের কম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বকেয়া বিদ্যুৎ বিল, ডলারের সংকট ও দরপত্র জটিলতায় কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পারছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এতে ৭টি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে পুরোপুরি বন্ধ আছে দুটি। আর চারটিতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
পরিবেশবাদীদের আপত্তি থাকলেও সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলেই কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দিকে যায় গত আওয়ামী লীগ সরকার। সময়মতো এসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসেনি। আবার উৎপাদনে আসার পর নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। বকেয়া বিল জমতে থাকায় চাপে পড়েছে এসব কেন্দ্র। ধাপে ধাপে বিল পরিশোধ বাড়াচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, তাপমাত্রা একটু কম থাকায় এখন বিদ্যুৎ চাহিদা তুলনামূলক কম। রাতে সর্বোচ্চ চাহিদা হচ্ছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। কয়লা থেকে উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাড়তি খরচে জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাড়তি উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এতেও চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ঢাকার বাইরে অনেক জায়গায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গতকাল রোববার ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে।
বকেয়া বিল, ডলার-সংকট, দরপত্র জটিলতায় কয়লার সরবরাহ কম। দুটি বন্ধ, ৪টিতে উৎপাদন ব্যাহত।
নিজস্ব কয়লায় চালিত একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে তিনটি ইউনিট মিলে সক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। এটি নিজস্ব খনির কয়লা দিয়ে চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লার অভাবে দুটি ইউনিট অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। বর্তমানে একটি ইউনিট বন্ধ। আর বাকি দুটি ইউনিট থেকে উৎপাদন হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ মেগাওয়াট। পুরো সক্ষমতায় উৎপাদন করতে দিনে পাঁচ হাজার টন কয়লা দরকার। যদিও চাহিদার অর্ধেক সরবরাহ করতে পারে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। এর বাইরে বাকি ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালিত হয় আমদানি করা কয়লা থেকে। আমদানির ডলার জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছে পিডিবি।
কয়লা–সংকটের কারণে গত ৩১ অক্টোবর থেকে পুরোপুরি বন্ধ আছে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র। দুটি ইউনিট মিলে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার পুরোপুরি উৎপাদনে ফিরতে পারে আগামী মার্চে। এর মধ্যে আগামী মাসের শুরুতে একটি ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিচালন) মনোয়ার হোসেন মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কয়লা আমদানি না হওয়া পর্যন্ত এই কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকবে।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সূত্র বলছে, কয়লা আমদানির দরপত্র নিয়ে জটিলতা আদালত পর্যন্ত গড়ানোয় আমদানিতে দেরি হয়ে গেছে। এক বছরের জন্য ৩৫ লাখ টন কয়লা সরবরাহে ইতিমধ্যে ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছে। মাসে প্রায় তিন লাখ টন কয়লা লাগে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এ ছাড়া গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর থেকে প্রথম ইউনিট ও চলতি বছরের ২৮ আগস্ট দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোনো বিল পায়নি এ বিদ্যুৎকেন্দ্র। তাদের সঙ্গে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) না হওয়ায় বিল পরিশোধ করা যায়নি। শিগগিরই এ চুক্তি হতে পারে।
এর বাইরে বরগুনার আমতলী এলাকার ৩০৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ আছে। গত ২৭ অক্টোবর থেকে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অংশ হিসেবে এটি বন্ধ করা হয়। পুনরায় উৎপাদনে ফিরতে আরও দুই সপ্তাহ লাগতে পারে।
বকেয়া বিল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চিঠি চালাচালি করছে ভারতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি আদানি ও পিডিবি। তবে বিষয়টির সুরাহা হয়নি। বর্তমানে আদানির দাবি অনুসারে পাওনা ৮৫ কোটি ডলারের বেশি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধে চাপ তৈরি করছে আদানি গ্রুপ। গত ৩১ অক্টোবর একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয় আদানি। বাকি ইউনিট থেকে ৭০০ মেগাওয়াটের বেশি করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। বকেয়া বিল পরিশোধের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলে এটিও বন্ধ করে দিতে পারে আদানি।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডায় নির্মিত। কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি ইউনিট আছে এ কেন্দ্রে। এতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২৫ বছর ধরে কিনবে বাংলাদেশ। প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় গত বছরের এপ্রিলে। দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় একই বছরের জুনে।
পিডিবির দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আগের চেয়ে বিল পরিশোধের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। গত মাসে তাদের বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। পরিশোধ করা হয়েছে বকেয়াসহ ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করা হতো। ব্যাংক পরিবর্তন করে এখন কৃষি ব্যাংকে ঋণপত্র খোলার মাধ্যমে বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ সোমবার এক কোটি ডলার পরিশোধ করা হতে পারে।
পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, একবারে পুরো বকেয়া পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া চাহিদামতো ডলারের সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ধাপে ধাপে বিল পরিশোধের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।
উৎপাদন শুরুর পর থেকে চাহিদামতো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে পটুয়াখালীর পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র। তবে গত বছর ডলার–সংকটে কয়লার বিল বকেয়া পড়ায় এক মাস বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছে কেন্দ্রটির। বর্তমানে একমাত্র কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে এটি পুরো সক্ষমতায় চালু আছে। বাংলাদেশ–চীন যৌথ উদ্যোগে এটি চলছে।
বাগেরহাটের রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি নির্মাণ শুরুর ১০ বছর পর একটি ইউনিট উৎপাদনে এসেছে। এরপর এ পর্যন্ত কয়েক দফায় বন্ধ ছিল। এর মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির পাশাপাশি ডলারের অভাবে কয়লা কেনার সংকটেও পড়েছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে নির্মিত এ কেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে এখন ৬০০ মেগাওয়াটের কম বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী এসএস পাওয়ার ১২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু আছে। এখন উৎপাদন হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৬০ মেগাওয়াট। আরেকটি ইউনিট বন্ধ বেশ কিছুদিন ধরে। বকেয়া বিল বাড়তে থাকায় কয়লার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। দুই ইউনিট চালানোর মতো কয়লা কেন্দ্রে নেই।
কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল রাখতে না পারলে আগামী মার্চে বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়বে এবং পরিস্থিত আরও খারাপ হতে পারে। এ বিষয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। এখন কয়লা আমদানির জন্য যে ডলার লাগবে, তা সংগ্রহ করে বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।