২০১৩ সালে নরওয়ের দাবাড়ু ম্যাগনাস কার্লসেন যখন প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। এরপর আরও পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি।
বগুড়ার ছাত্র রুদ্র অভিজিৎ সাহার প্রিয় খেলোয়াড় এই ম্যাগনাস কার্লসেন।
কার্লসেনের মতো খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে রুদ্র। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। ধীরে ধীরে সেই স্বপ্নডানায় যুক্ত হচ্ছে সাফল্যের পালকও। ‘মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতায় রাজশাহী বিভাগের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রুদ্রর বগুড়া জিলা স্কুল দাবা দল।
রুদ্র অভিজিৎ সাহার মতো খুদে দাবাড়ুদের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে এবং আবুল খায়ের গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশব্যাপী চলছে এ আয়োজন, যেখানে চূড়ান্ত বিজয়ী দলের সদস্যরা পুরস্কার ছাড়াও পাবে বিদেশ থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্র্যান্ডমাস্টার উপাধি অর্জনের সুযোগ।
দাবার মোট ঘর ৬৪ এবং দুই পক্ষ মিলিয়ে মোট গুটি ৩২টি। এই ৩২ গুটি দিয়েই নিজেদের জাত চিনিয়েছে রুদ্ররা। বুদ্ধির খেলায় চ্যাম্পিয়ন হতে পেরে দলের সব সদস্যের চোখেমুখে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ছটা। কারণ, ফাইনালে নিজের স্কুলের বড় ভাইদের হারিয়ে সেরা হয়েছে তারা।
‘আমরা যখন নাম নিবন্ধন করি, কেউ পাত্তাই দেয়নি। সবার ধারণা ছিল আমরা জেলা পর্যায়েই হেরে বিদায় নেব। কিন্তু প্রথমে জেলা পর্যায়ে, এরপর বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হই আমরা। এখন দেশসেরা হওয়ার অপেক্ষায়...।’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে বগুড়া জিলা স্কুল দাবা দলের অধিনায়ক।
বড় ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতেই দাবার প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে রুদ্রর। এখন দাবাই তার অবসর সময়ের সঙ্গী। রুদ্র একা নয়, তার দলের বাকি সদস্য মো. ইশতিয়াক হামিদ, রেদওয়ানুল মোস্তফা, সবুর সরকার, কে এম সালমান ফারসী ও রাগিব রওনাক দাবা খেলেই দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনতে চায়।
দাবা খেলা রপ্ত করার জন্য বাসার অন্য সব খেলনা ফেলে দাবার গুটি আর বোর্ড নিয়ে সারা দিন পড়ে থাকত সবুর সরকার। সাদা-কালো আয়তক্ষেত্রগুলো তার কোমল মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। ‘করোনার সময় সারাক্ষণ দাবা খেলা নিয়ে পড়ে থাকত সবুর। খাওয়ার সময়ও এক হাতে খেত, আরেক হাত দিয়ে দাবা খেলত সে।’ এমনটাই জানালেন সবুর সরকারের মা সালেহা খাতুন। শুরুর দিকে সবুরের দাবাপ্রীতিকে সহজভাবে না নিলেও তার এমন সাফল্যে খুশি মা-বাবাসহ পুরো পরিবার। আর এমবিবিএস–পড়ুয়া ভাইয়ের কাছ থেকে দাবার খুঁটিনাটি বিষয় ভালোভাবে জেনে নিচ্ছেন বগুড়া জিলা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া খুদে এ দাবাড়ু। কারণ, সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ!
চ্যাম্পিয়ন দলেন অন্য সদস্য রাগিব রওনাক পরিবার-স্বজন ছাড়াও পাড়ার বড়দের সঙ্গে দাবা খেলে প্রায়ই জিতত। ছেলের প্রতিভা দেখে মা-বাবা তাকে দাবাড়ু হিসেবেই গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। এ কারণে পরিবার থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছে সে। রাগিবের স্মৃতিশক্তি অসাধারণ! পড়াশোনায় ভালো করার পাশাপাশি এ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আরও দক্ষতা অর্জনের জন্য দাবার বিভিন্ন চাল ও কৌশল আয়ত্ত করে চলেছে রাগিব।
‘হয়ে ওঠো আগামীর গ্র্যান্ডমাস্টার’ স্লোগানে চলা প্রতিযোগিতাটি দেশের স্কুলভিত্তিক দলগত দাবার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট। বগুড়া জিলা স্কুল দাবা দলের সদস্য কে এম সালমান ফারসীর লক্ষ্যও গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া। তাই দেশ-বিদেশের গ্র্যান্ডমাস্টারদের জীবনী তার অনুপ্রেরণা জোগায়। সালমানের দাবা খেলার ধরনটাও একটু আলাদা।
একই সঙ্গে গুটির অবস্থান ধরে রেখে আবার অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে খেলতে পছন্দ করে সে। প্রতিপক্ষের সামান্যতম ভুলকে দীর্ঘশ্বাসে রূপান্তর করতে তার জুড়ি নেই। তবে খেলা যত এগোতে থাকে, ততই স্পষ্ট হতে থাকে সালমানের ধারালো কৌশলের আসল রহস্য।
মো. ইশতিয়াক হামিদ ছোটবেলা থেকেই খেলোয়াড় হতে চেয়েছিল। উপহার হিসেবে খেলার কোনো উপকরণ পেলে ভীষণ খুশি হতো। বাড়ির চারপাশ সবুজে ঘেরা হলেও খেলার মতো জায়গা কম ছিল। তাই খেলার জন্য মাঠ না পাওয়ায় ঘরের মধ্যেই দাবা খেলায় মগ্ন হয় ইশতিয়াক হামিদ। দাবাড়ু হওয়ার ইচ্ছাকে মনের মধ্যে লালন করে চলেছে সে। সেই চেষ্টা, আগ্রহ আর একাগ্রতার ফল পেল বিভাগীয় ‘চ্যাম্পিয়ন’ দলের সদস্য হয়ে। যে চ্যাম্পিয়ন দলের সব সদস্যের ইচ্ছা আর স্বপ্ন জমা হয়েছে একই রেখায়, সেটা হলো দাবার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়া।