ডাকের পোস্ট ই-সেন্টার

ব্যয় ৩৮০ কোটি টাকা, সুফল ‘সামান্য’

চট্টগ্রামের পটিয়ায় বন্ধ থাকা ই–সেন্টার। ৯ জুলাই
ছবি: আবদুর রাজ্জাক

গ্রামের মানুষকে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সেবা দিতে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ২৪টি ডাকঘরে পোস্ট ই-সেন্টার চালু করেছিল ডাক বিভাগ। এখন সব কটিই বন্ধ।

মোটামুটি একই চিত্র বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায়। সেখানে চালু করা হয়েছিল ২০টি কেন্দ্র। এখন ১৫টিই বন্ধ। চালু থাকা কেন্দ্রে যেসব সেবা পাওয়ার কথা, তার কোনোটিই পাওয়া যায় না।

সারা দেশে ডাক বিভাগের করা ৫ হাজার ৮০০টি পোস্ট ই-সেন্টার নিয়ে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রগুলো উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রকল্পে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩৮০ কোটি টাকা।

একই ধরনের দুটি প্রকল্প নিয়ে জনগণের অর্থ অপচয় করা হয়েছে। আর এ ধরনের প্রকল্পের নজরদারিও খুব কম। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) উচিত প্রকল্পে নজরদারি বাড়ানো।
আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান

ডাক বিভাগ ২০১২ সালে ‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয়। এর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল, গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যকার ডিজিটাল পার্থক্য দূর করে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া। এক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০১৭ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়। প্রকল্প শেষ হলেও ই-সেন্টারগুলো চালু থাকার কথা।

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তর পারফরম্যান্স অডিট বা পারদর্শিতা মূল্যায়নভিত্তিক নিরীক্ষা চালায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত সময়ে। তারা ৯০০টি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছিল। নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি গত মাসে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়।

নিরীক্ষাকালেই ২০ শতাংশ ই-পোস্ট সেন্টার বন্ধ পাওয়া যায়। প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা সম্প্রতি পাঁচটি উপজেলায় ১০১টি ই-সেন্টারে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, ৫০টি চালু আছে। আর ৫১টি বন্ধ। তবে সাধারণ মানুষ এই সেন্টার সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না।

ইন্টারনেটভিত্তিক ২২ ধরনের সেবা দেওয়া ছিল এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। অনলাইনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আবেদনের ফরম পূরণ, কৃষিক্ষেত্রে অনলাইনে কৃষিসংক্রান্ত তথ্যাবলি জানাতে সহায়তা দেওয়া, অনলাইনে স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করা, ওয়েবক্যামের মাধ্যমে প্রবাসী স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ইত্যাদি ছিল সেবার তালিকায়।

অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল (পোস্টাল অ্যাটাচি) মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যে আশা নিয়ে পোস্ট ই-সেন্টার চালু করা হয়েছিল, তা পূরণ হয়েছে। কেন্দ্রগুলোতে ১ লাখ ২৮ হাজার মানুষকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তারা পদত্যাগ করায় কিছু জায়গায় সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে উদ্যোক্তা নিয়োগের কাজ চলছে।

ই-সেন্টারের মতো প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারের উদ্যোগে করা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। ২০১০ সালে যা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানেও মানুষকে একই ধরনের সেবা দেওয়া হয়। ফলে একই ধরনের কাজে সরকারের দুই সংস্থার প্রকল্পে অর্থ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

কী কী সেবা দেওয়ার কথা

ডাক বিভাগের অবিভাগীয় ও শাখা ডাকঘরগুলোতে উদ্যোক্তা নিয়োগ করে ই-সেন্টার চালু করা হয়। প্রকল্পের আওতায় উদ্যোক্তাদের ল্যাপটপসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেয় ডাক বিভাগ।

ইন্টারনেটভিত্তিক ২২ ধরনের সেবা দেওয়া ছিল এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। অনলাইনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আবেদনের ফরম পূরণ, কৃষিক্ষেত্রে অনলাইনে কৃষিসংক্রান্ত তথ্যাবলি জানাতে সহায়তা দেওয়া, অনলাইনে স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করা, ওয়েবক্যামের মাধ্যমে প্রবাসী স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ইত্যাদি ছিল সেবার তালিকায়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পটির আওতায় অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম (ডিভাইস) কেনার মাধ্যমে ৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা অপচয় করা হয়েছে। অনেক ই-সেন্টার চালু না হওয়ায় যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। অনেক কেন্দ্রে আসবাব পাওয়া যায়নি। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে।

নিরীক্ষায় যা উঠে এল

প্রকল্পের উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে কি না, তার মূল্যায়ন করতে গিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ই-সেন্টারে সেবাদানের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। উদ্যোক্তারা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের মূল কাজ দোকানদারি। কারও ওষুধের দোকান, কারও মনিহারি দোকান, কারও মুঠোফোন মেরামতের দোকান। তাঁরা মূল ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ই-সেন্টারের কাজে সময় দিতে পারেন না।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উদ্যোক্তা নিয়োগে নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে অদক্ষ উদ্যোক্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া নিয়মিত তদারকি না করার কারণে প্রকল্প উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

পল্লির জনগোষ্ঠীর ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করার জন্য অধিকাংশ কেন্দ্রে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। বলা হয়, পোস্টাল সেভিংস ব্যাংক ও পোস্টাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের কার্যক্রম প্রসারিত করা, ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতা বিতরণ, আইটিভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরি, প্রবাসী আয় পৌঁছানো, শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ইত্যাদি উদ্দেশ্যের কথা প্রকল্পে বলা হয়েছিল। তবে তা পূরণ হয়নি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পটির আওতায় অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম (ডিভাইস) কেনার মাধ্যমে ৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা অপচয় করা হয়েছে। অনেক ই-সেন্টার চালু না হওয়ায় যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। অনেক কেন্দ্রে আসবাব পাওয়া যায়নি। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে।

সরেজমিন চিত্র

প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা আগৈলঝাড়া ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়াও মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান, রংপুর সদর ও চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় পোস্ট ই-সেন্টারগুলোর বিষয়ে খোঁজ নেন। তাতে দেখা যায়, আগৈলঝাড়ার ও ত্রিশালের মতো সিরাজদিখানের বেশির ভাগ ই-সেন্টার বন্ধ। ১৪টির মধ্যে সচল ৫টি। পটিয়ায় ৩০টি সেন্টারের মধ্যে ২৮টি সচল আছে। আর রংপুর সদরের ১৩টি পোস্ট ই-সেন্টারের মধ্যে ১২টি চালু আছে।

ডাকঘর–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সেবাপ্রত্যাশী কম থাকায় আয় কম। এ কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ই-সেন্টারগুলো। তবে কিছু ই-সেন্টারে এখন মুঠোফোনে লেনদেন ও ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা চালু রয়েছে।

সিরাজদিখান উপজেলা ডাকঘরে গিয়ে সম্প্রতি দেখা যায়, ই-সেন্টারের সেবা দেওয়ার জন্য উদ্যোক্তা মো. জাকির হোসেন ল্যাপটপ নিয়ে বসে রয়েছেন। সেবাগ্রহীতা নেই। তিনি বলেন, সেখানে খরচ অনেক কম। তবু মানুষ আসে না।

সিরাজদিখানের অনেক সেবাই নেই, যেগুলো দেওয়ার কথা প্রকল্পে বলা হয়েছে। সিরাজদিখান উপজেলা পোস্টমাস্টার রিপন ভূইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ই-সেন্টারে ই-বিজনেস, টেলিমেডিসিন সেবা, কৃষি তথ্যসেবা, বালাই ব্যবস্থাপনা সেবা এখনো শুরু হয়নি। তবে ডাক ঘরে ই-কমার্সের সেবা, বিমা পলিসি বিক্রয় এবং প্রিমিয়াম আহরণ ও বিতরণের ব্যবস্থা রয়েছে।

ই-সেন্টার প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়া এবং একই ধরনের কাজে দুটি প্রকল্প নেওয়ার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ বিষয়ে আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, একই ধরনের দুটি প্রকল্প নিয়ে জনগণের অর্থ অপচয় করা হয়েছে। আর এ ধরনের প্রকল্পের নজরদারিও খুব কম। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) উচিত প্রকল্পে নজরদারি বাড়ানো।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর; প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জ, গৌরনদী ও পটিয়া, চট্টগ্রাম]