ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে (মর্যাদা বজায় রেখে যোগাযোগ করি) প্রথমেই ছয়টি পরিস্থিতির ছয়টি ছবি দেওয়া। এসব পরিস্থিতিতে কী ধরনের যোগাযোগ হয়, তা শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আলোচনা করে এবং ভূমিকা-অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে। যেমন একটি ছবিতে রাতের খাওয়া শেষে পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে কথা বলার চিত্র দেওয়া হয়েছে। সেখানে সারা দিন কে কী করেছে, তা নিয়ে কথা হচ্ছে।
ছবিগুলোর একেকটির পরিস্থিতিতে মর্যাদা বজায় রেখে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখা উচিত বলে একজন শিক্ষার্থীর কাছে মনে হয়, তা বইয়েই লেখার জন্য আলাদা করে ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে। এভাবে ধারাবাহিকভাবে ভাষায় মর্যাদা প্রকাশ, মর্যাদা অনুযায়ী সর্বনাম ও ক্রিয়া, সর্বনামের রূপ, ক্রিয়ার রূপ, সর্বনাম ও ক্রিয়া দিয়ে বাক্য তৈরি, ভাষিক ও অভাষিক যোগাযোগ, যোগাযোগের অনুশীলন, জরুরি প্রয়োজনে কারও সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হয়, তা শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাতটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ, প্রমিত ভাষায় কথা বলা, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি পড়ে বুঝতে পারাসহ সাতটি দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর রেখে সাজানো হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি করা ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বাংলা’ বইটি। একটি বই দিয়েই বাংলার নানা বিষয় শেখানো হবে, যা এত দিন তিনটি বই দিয়ে শেখানো হতো। বই তিনটি হলো আনন্দ পাঠ (বাংলা দ্রুত পঠন), বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি এবং চারুপাঠ।
শুধু বাংলা বই-ই নয়, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রথম থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেণির বই-ই বদলে যাচ্ছে। বিষয়বস্তু, বিন্যাসসহ সব ক্ষেত্রেই আনা হচ্ছে বড় রকমের পরিবর্তন। এর মধ্যে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আগামী জানুয়ারি থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই হাতে পাবে।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) মো. মশিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু শিখনপ্রক্রিয়ার পুরোনো ধরনই বদলে যাচ্ছে, সুতরাং সেটি মাথায় রেখেই পাঠ্যবইগুলোও একেবারে নতুন আঙ্গিকে তৈরি হচ্ছে। আগামী বছর থেকে যেসব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেওয়া হবে, তা লেখার কাজও শেষ করা হয়েছে। এখন ছাপা হচ্ছে। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের বিষয়টি মাথায় নিয়ে বইগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে ও হচ্ছে। এতে ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণির বই প্রণয়ন করা হবে। তবে কোন শ্রেণিতে কতগুলো বই হবে, তা ঠিক হয়ে গেছে।
এনসিটিবির সূত্রমতে, আগামী জানুয়ারিতে শুরু হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষে (২০২৩ সালে) প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বই পাবে শিক্ষার্থীরা। এখন চলছে বই ছাপার কাজ। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বই পড়ানো হবে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা (প্রত্যকে ধর্ম অনুযায়ী) এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। বর্তমানে মাধ্যমিকে ১৪টি বই পড়ানো হয়। এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু অভিন্ন বই পড়তে হয়। আর নবম শ্রেণিতে শাখা বিভাজন হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শাখা পরিবর্তন হবে।
তবে প্রাথমিক স্তরে বইয়ের সংখ্যা কম। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর জন্য আটটি বিষয় ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি। তবে সব বিষয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা বই পাবে না। যেমন প্রথম শ্রেণির বই হবে এখনকার মতোই তিনটি। কিছু বই ‘শিক্ষক গাইডের’ আলোকে পড়ানো হবে। আর প্রাক্-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শেখাবেন।
এনসিটিবি এবং বই লেখার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণয়ন করা বইগুলোয় বিষয়বস্তুর পাশাপাশি ছবি, অলংকরণ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু এমনভাবে লেখা হয়েছে, যাতে বইগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে অনেক বেশি সহজ ও আনন্দময় হয়। এর মাধ্যমে চারপাশের প্রতিনিয়ত ঘটে চলা বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনার সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের একটি সংযোগ তৈরির চেষ্টা হয়েছে।
যেমন ষষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের প্রথম অধ্যায়টি (সুস্থ থাকি, আনন্দে থাকি, নিরাপদে থাকি) এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেখানে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ধরনের কাজকে তুলে আনার ব্যবস্থা করা হয়। সেগুলো নিয়ে শিক্ষার্থীরা সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করে ভালো থাকা বা সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ধারণাগুলো জেনে নেবে। একটি স্বাস্থ্য মেলা আয়োজনের মাধ্যমে সবার সামনে সেসব ধারণা তুলে ধরতে হবে। সারা জীবন যাতে ভালো থাকার এ যাত্রা অব্যাহত থাকে, সে শিক্ষাও দেওয়া হবে। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের নির্দেশনায় কিছু মজার শরীরচর্চা করা হবে। একই সঙ্গে এই শরীরচর্চাগুলো বাড়িতেও নিয়মিত পরিবারের অন্য সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে করার শিক্ষা দেওয়া হবে। আবার বইয়েই ‘আমার দিনলিপি’ নামের একটি অংশে সকাল, দুপুর, বিকেল ও রাতের কাজের বিবরণ লিখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এগুলো নিয়ে আবার সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এভাবে নানা বিষয় শেখানোর ব্যবস্থা করে বইটি সাজানো হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এ বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে (আমার কৈশোরের যত্ন) কিছু কমিক এবং বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে শেখানো হয়েছে। কথা বলার ছলে ছয়টি অধ্যায়ে বইটি সাজানো হয়েছে।
বর্তমানে দেশের মাধ্যমিক স্তরের ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ জন্য যেসব বই তৈরি করা হয়েছে, সেখানেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন পরীক্ষামূলক বইয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ের (সাহিত্য পড়ি, লিখতে শিখি) দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তিনটি গান ছিল। এগুলো হলো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমরা সবাই রাজা’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ এবং আবদুল আলীমের গান (গীতিকার এ কে এম আবদুল আজিজ) ‘কলকল ছলছল’। বইয়ে লিখিতভাবে দেওয়ার পাশাপাশি কিউআর কোডও দেওয়া হয়েছিল, যাতে শিক্ষার্থীরা কিউআর কোডটি স্ক্যান করে গানটি শুনতে পারে। কিন্তু পরিমার্জন করে এখন কেবল ‘আমরা সবাই রাজা’ গানটি রাখা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে কিউআর কোডও। এ পরিচ্ছেদে শ্রেণিকক্ষে সবাই মিলে গানটি গাইতে হবে। গানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গান বিষয়ে কী বুঝল, সেটির চর্চা করা হবে। বইয়েই একটি অংশে কী বুঝতে পারল, তা লেখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এনসিটিবি সূত্রমতে, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়েও বেশ কিছু বিষয়বস্তু ও ছবি বাদ দেওয়া হয়েছে। এ রকমভাবে আরও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
গণিত বইটি মোট ১২টি শিখন–অভিজ্ঞতা দিয়ে সাজানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সক্রিয় ও অংশগ্রহণ ও বাস্তব উপকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন গাণিতিক ধারণা দেওয়া হয়েছে বইয়ে।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথাগত পরীক্ষার চেয়ে ধারাবাহিক (বছরজুড়ে নানা কার্যক্রম) মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য বইয়ে যেসব জায়গা লেখার অংশ রয়েছে, সেগুলোও ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির সদস্য মো. মশিউজ্জামান।
ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইটি রচনা ও সংকলনের দায়িত্বে থাকা সাতজন শিক্ষকের মধ্যে একজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক তারিক মনজুর। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবইয়ের নানা পরিবর্তনের কথা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বইয়ে তথ্য মুখস্থ করার বিষয়টিকে এড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ সাইকেলের যন্ত্রাংশ কটি, সেটি মুখস্থ না করে সাইকেলটি চালানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি লিখেছেন শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ও ‘ইউজিসি প্রফেসর’ হাসিনা খানসহ কয়েকজন। বিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সহায়ক বই দেওয়া হবে, যেখানে সমস্যা সমাধানের ধাপগুলো বিস্তারিতভাবে দেওয়া হয়েছে। হাসিনা খান মনে করেন, নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ে আনন্দ পাবে।