রোববার সকাল আটটা। চট্টগ্রাম নগরের কদমতলী রেলক্রসিং এলাকা। চার লেনের সড়কে গাড়ির তেমন চাপ নেই। এই সময় ট্রেন আসার সংকেত বেজে উঠল। রেলের গেটম্যান রফিকুল ইসলাম রেলক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক নামিয়ে দিলেন। কিন্তু চালকেরা সংকেত উপেক্ষা করে প্রতিবন্ধককে পাশ কাটিয়ে গাড়ি চালাতে থাকেন। পথচারীরাও ঝুঁকি নিয়ে পার হন রেললাইন।
ট্রেন একেবারে কাছাকাছি এলে গেটম্যান পতাকা নাড়িয়ে উল্টো পাশ দিয়ে আসা গাড়িগুলোকে কোনো রকমে দাঁড় করালেন। এরপরও ট্রেনের অনেকটা কাছাকাছি চলে যায় গাড়িগুলো। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়।
কদমতলী রেলক্রসিংয়ের এ দৃশ্য শুধু রোববার সকালের নয়—প্রতিদিনই ট্রেন আসার সংকেত ও প্রতিবন্ধক উপেক্ষা করে যান চলাচলের ঘটনা ঘটে সেখানে। ঘটে দুর্ঘটনাও। চট্টগ্রাম নগরে রেলক্রসিংয়ে সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায়।
শনিবার আমবাগান রেলক্রসিংয়ে রেললাইনের ওপর ট্রেন ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষের পর রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। তবে রেলসেতুর নির্মাণকাজ চলার কারণে ট্রেনের গতি কম থাকায় ও মাইক্রোবাসটিতে যাত্রী না থাকায় এদিন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু নানা সময়ে নগরের রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
গত দেড় বছরে চট্টগ্রামে রেলক্রসিংয়ে অন্তত তিনটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ১৯ জন। এর মধ্যে মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া স্টেশন এলাকায় ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ২৯ জুলাই। ওই দুর্ঘটনায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে নিয়ে যায় মহানগর প্রভাতী ট্রেন। এতে মাইক্রোবাসের ১৩ জন নিহত হন।
দুর্ঘটনার দিন বড়তাকিয়া রেলস্টেশন এলাকার রেলক্রসিংয়ে থাকা গেটম্যান প্রতিবন্ধক ফেলেছিলেন। কিন্তু প্রতিবন্ধক ফেলার পর তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। এ সময় কেউ একজন প্রতিবন্ধক তুলে দেন। এতেই ঘটে দুর্ঘটনা।
এর আগের বছর ২০২১ সালের ৪ ডিসেম্বর খুলশীর ঝাউতলা রেলক্রসিংয়ে আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে। ডেমু ট্রেনের সঙ্গে বাস, অটোরিকশা ও টেম্পোর সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় এক পাশে প্রতিবন্ধক ফেললেও অন্য পাশের প্রতিবন্ধক ফেলা হয়নি।
তবে সেদিন প্রতিবন্ধক দেওয়া না থাকলেও ট্রেন আসতে দেখে সেখানে থাকা গাড়িগুলো রেললাইনের একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দ্রুতগামী একটি বাস পেছন থেকে এসে অটোরিকশা ও টেম্পোকে ধাক্কা দেয়। এতে তিনটি যানই ডেমু ট্রেনের ওপর আছড়ে পড়ে।
সর্বশেষ বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে দুই মাস আগে গত ৬ মার্চ ইপিজেড থানার বিমানবন্দর সড়কে। ট্রেনের চলন্ত ইঞ্জিনে যাত্রীবাহী একটি বাসের ধাক্কায় তিনজনের মৃত্যু হয়। ইঞ্জিন আসার সংকেত উপেক্ষা করে বাস চালিয়ে যাওয়ার কারণে ঘটে এ দুর্ঘটনা।
রোববার সকাল আটটায় কদমতলী রেলক্রসিং অতিক্রম করে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেন। ট্রেন আসার আগে প্রতিবন্ধক ফেলা হলেও তা উপেক্ষা করে রেললাইন পার হন ভ্যানচালক মো. হানিফ। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার তাড়া আছে। বিভিন্ন বেকারিতে পণ্য পৌঁছে দিতে হবে। তাই তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে।’ তবে তিনি দাবি করেন, এর আগে কখনো তিনি এভাবে গাড়ি চালিয়ে নেননি।
একইভাবে সংকেত উপেক্ষা করে বিপরীত পাশ দিয়ে যান সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক মো. সেলিম। তিনি দাবি করেন, গাড়িতে থাকা যাত্রীদের মেডিকেলে যেতে হচ্ছে। এ জন্যই উল্টো পথ দিয়ে চলে এসেছেন। তাঁর ভুল হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কদমতলী রেলক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক উপেক্ষা করে একের পর এক গাড়ি চলছে। এসবের মধ্যে ছোট ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা দেখা যায়।
চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে বের হওয়ার পরই প্রথম রেলক্রসিং কদমতলী। এই রেলক্রসিং দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রেন চলাচল করে। দিনে গড়ে অন্তত ২৫ জোড়া ট্রেন চলাচল করে ব্যস্ততম এই রেলক্রসিং দিয়ে।
এ ক্রসিংয়ে গেটম্যানের দায়িত্বে আছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রেলক্রসিংয়েই যেন মানুষের তাড়া বেড়ে যায়। কোথায় এখানে সাবধান থাকবে, তা না, কে কার আগে যাবে, সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এমনকি গাড়ি নিয়ে ট্রেনের সামনে পর্যন্ত যায়। এসব দেখে মনে হয়, কারও মৃত্যুভয় নেই। অথচ চার-পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করলেই হয়।
কদমতলী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আমবাগান রেলক্রসিং। কদমতলী দিয়ে যেমন ঢাকাসহ সারা দেশের ট্রেন চলাচল করে, তেমনি আমবাগান দিয়ে চলাচল করে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নাজিরহাট ও দোহাজারীগামী ট্রেন। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জোড়া ট্রেন চলাচল করে এই রেলক্রসিং দিয়ে।
আজ রোববার সকাল সাড়ে আটটায় এই রেলক্রসিংয়ের দুই গেটম্যান জাকির হোসেন ও আকলিমার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। জাকির ও আকলিমা পালাক্রমে রেলক্রসিংয়ে দায়িত্ব পালন করেন। গেট আছে দুই পাশে দুটি।
জাকির ও আকলিমা বললেন, মানুষ পাঁচ মিনিটও ধৈর্য ধরতে চান না। সংকেত বেশি অমান্য করেন মোটরসাইকেলচালকেরা। চিৎকার করেও তাঁদের থামানো যায় না। থামতে বললে উল্টো অনেকে দুর্ব্যবহার করেন। তখন একপ্রকার অসহায় হয়ে পড়েন তাঁরা। একই অভিযোগ কদমতলী রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান রফিকুল ইসলামেরও।
জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবদুল হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, রেলক্রসিংগুলো নিরাপদ ও সুরক্ষিত করতে তাঁদের পক্ষ থেকে চেষ্টার কমতি নেই। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ প্রতিবন্ধক উপেক্ষা করে চলাচল করেন। এতে ঝুঁকি তৈরি হয়। মানুষ সচেতন হলে দুর্ঘটনা অনেকটা কমবে।