২৫ মার্চ কালরাত

ফুলবানুদের খবর রেখেছে কে 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃশংসতার শিকার পরিবারগুলোর সদস্যদের দিন কাটছে নানা সংকটে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ফুলবানুর ঊরুতে গুলি লাগে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

ফুলবানুর বয়স খুব বেশি হলে ১৫ বা ১৬ বছর। কোলে দেড় বছরের ছেলে। ঘরের দরজা থেকেই পাকিস্তানি মিলিটারিরা গুলি করতে থাকে। গুলিতে চোখের সামনে স্বামী আবদুল খালেক আর ফুলবানুর ১০ বছর বয়সী ছোট বোন নূর জাহান নূরী নিহত হলেন। ফুলবানু নিজেও ঊরুতে গুলিবিদ্ধ হলেন।

ফুলবানু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী। ফুলবানু আর তাঁর ছেলে হারুন অর রশীদ সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন। ফুলবানুর শরীরে যেখানে গুলি লেগেছিল, সেখানে বড় একটি গর্ত হয়ে গেছে। সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পেয়ে এখন আগের অনেক কথাই আর স্পষ্ট মনে রাখতে পারেন না।

ফুলবানু শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর স্বামী আবদুল খালেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের মালি ছিলেন। স্ত্রী–সন্তান নিয়ে থাকতেন হলের স্টাফ কোয়ার্টারে। কোয়ার্টারটি ছিল বর্তমানে শামসুন নাহার হলের অফিস যেখানে, সে জায়গায়। হলের গেটের পাশেই একটি গর্তে ফুলবানুর স্বামী আর বোন নূরীর লাশ ফেলেছিল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরেরা।

 ১৯৭৩ সাল থেকে ফুলবানু শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ী এলাকার আবাসিক কোয়ার্টারে বাস করছেন। ১৯ মার্চ সেখানে বসেই কথা হলো ফুলবানুর সঙ্গে। ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আর বিয়ে করেননি ফুলবানু।

আবদুল খালেকের মতো ওই রাতে রোকেয়া হলের সাত কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যসহ মোট ৪৫ জন শহীদ হয়েছিলেন। রোকেয়া হল চত্বর, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনসহ বিভিন্ন জায়গার নামফলকে এই শহীদেরা জায়গা পেয়েছেন। কেবল ২৫ মার্চ এলেই গণমাধ্যমকর্মী, গবেষকসহ অনেকেই ফুলবানুদের খবর নিতে যান। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে তাঁদের। 

ফুলবানুদের জীবনের যুদ্ধ শেষ হয়নি

দিন–তারিখ মনে রাখতে না পারলেও প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন ফুলবানু কথা বলছিলেন, গণহত্যার ওই রাতের ভয়াবহতা তাঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠে। বারবার বলছিলেন, ‘যুদ্ধ দিয়া জীবন শুরু হইছিল, এই যুদ্ধ তো আর শেষ হয় না। পায়ে গুলি খাইছিলাম বইল্যা আমি নিজে চাকরি পাই নাই, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষরে আমার ছেলেটারে একটা চাকরি দিতে কইছিলাম, ছেলেটারেও একটা চাকরি দিল না। ভাতা বন্ধ হইছে মেলা দিন হইল। এখন খালি বাসাটা আছে।’

বিয়ে, সন্তানের জন্ম আর বিধবা হওয়া—ফুলবানুর জীবনে তিনটিই ঘটেছে খুব কম সময়ের ব্যবধানে। ছেলেকে বড় করতে পায়েচালিত একটি সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করে সংসার চালিয়েছেন দীর্ঘদিন। এখন পলিথিন দিয়ে সেলাই মেশিনটি ঢেকে রেখেছেন। ফুলবানুর ছেলে একটি দোকানে কাজ করেন। ঘরে আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই। তবে স্টিলের একটি আলমারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সই করা চিঠি, স্বামীর ছবিসহ সবকিছু যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সই করা চিঠিতে বঙ্গবন্ধু ফুলবানুকে স্বাধীনতাসংগ্রামে তাঁর পরিবারের আত্মোৎসর্গের জন্য সমবেদনা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে এক হাজার টাকার চেক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সবই রেখে দিয়েছেন যত্ন করে। স্বামীর কথা উঠতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফুলবানু বললেন, ‘আগে যদি জানতাম স্বামী মইরা যাইব, তাইলে নিউমার্কেটে গিয়া দুজনের একটা ছবি তুইল্যা রাখতাম।’

গণকবরের দৃশ্য ভুলতে পারেন না মোশাররফ

মোশাররফ হোসেন

শিববাড়ী আবাসিক এলাকার কোয়ার্টারেই থাকছেন শহীদ আহাম্মদ আলী ফরাজীর ছেলে মোশাররফ হোসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তাঁর বয়স ছিল ৯ বছর। তবে বাবাকে হারানোর পর ওই বয়সেই তাঁর দুই ভাই, তিন বোন ও মাকে দেখার দায়িত্বসহ অনেক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল। আহাম্মদ আলী ফরাজীর সঙ্গে তাঁর এক আত্মীয় আবদুস সাত্তার সরকারও শহীদ হন।

মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পেছনে কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধে দাঁড়িয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের গেট ঘেঁষে কালো রঙের ‘স্মৃতি ’৭১ অমলিন’ নামের একটি স্তম্ভ আছে। ২৫ মার্চ রোকেয়া হলের স্টাফ কোয়ার্টারে হত্যার শিকার কয়েকজনকে এখানেই গর্ত করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। দৈনিক আজাদসহ তখন প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া খবর অনুযায়ী, ১৯৭২ সালের ২০ এপ্রিল খনন করা হয় এই গণকবর। উদ্ধার করা হয় শহীদদের মাথার খুলি, কঙ্কাল, হাতে থাকা ঘড়ি, হাতের চুড়ি ও চুল। কঙ্কালগুলো উদ্ধারের পর বর্তমানে কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে কবর দেওয়া হয়। সেখানে আহাম্মদ আলী ফরাজীর নামসহ কবরটিও আছে।

মোশাররফ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে বিদ্যুৎ শাখার জ্যেষ্ঠ কার্য সহকারী হিসেবে কর্মরত। ২৫ মার্চ সকালে আত্মীয় আবদুস সাত্তার সরকারের সঙ্গে মোশাররফ হোসেনকে তাঁর বাবা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আবদুস সাত্তার গেন্ডারিয়া পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসেন এবং পরে শহীদ হন। মোশাররফ ঢাকায় ফিরেছিলেন ২৭ মার্চ। গণকবরে কোনো রকমে মাটিচাপা দেওয়ায় কারও হাত, কারও পা বের হয়ে ছিল—এ দৃশ্য এখনো ভুলতে পারেননি মোশাররফ। অন্যদের কাছ থেকে জানতে পারেন তাঁর বাবাকে গুলি করে মারে পাকিস্তানি সেনারা।

মোশাররফ হোসেন জানালেন, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সই করা একটি চিঠি তাঁর পরিবারও পেয়েছিল। ১৯৮৯ সালের আগপর্যন্ত (খুব সম্ভবত দেড় শ টাকা) ভাতাও পান তাঁর মা। ২০০৪ সালে মোশাররফ হোসেনের মা মারা যান।

মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাবা শহীদ হওয়ার পর আমাকে শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। সংসারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে পারিনি। সামাজিক অবহেলা তো ছিলই।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যার শিকার পরিবারগুলোর ভাগ্য অনিশ্চিত

শুধু রোকেয়া হল নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলেও চলে গণহত্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, শহীদ পরিবার কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ পরিবার কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডসহ বিভিন্ন ব্যানারে তাঁদের পরিবারের বাসস্থান সমস্যার স্থায়ী সমাধান করাসহ বিভিন্ন দাবি জানাচ্ছেন। ১৯৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শহীদ পরিবার সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী এই পরিবারের সদস্যদের জন্য তাঁর দরজা সব সময় খোলা থাকবে বলে জানিয়েছিলেন। তবে শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, যাঁরা বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন, তাঁরা এ বাসা থেকে উচ্ছেদ–আতঙ্কে আছেন। অনেকের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া আছে।

ঢাবির কলাভবনের সামনে গণহত্যার শিকার শহীদদের নামফলক

২০২১ সালের ২৫ মার্চ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ মানুষকে ‘গণশহীদ’ হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, গণশহীদদের কীভাবে সম্মানিত করা যায়, একটা তালিকা করে সনদ দেওয়া যায় কি না, তা সরকার ভাবছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ২০২১ সালের ১ মার্চ রোকেয়া হল চত্বরে শহীদদের স্মরণে নির্মিত ‘স্মৃতিফলক’ উদ্বোধন করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শহীদ পরিবারকে সুরক্ষা দিচ্ছি। রাষ্ট্রীয় নীতি হচ্ছে এই পরিবারগুলোকে সহায়তা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের যতটুকু সামর্থ্য তা করছে, অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে। এই পরিবারের সদস্যরা পড়াশোনা করে যাতে একটি পর্যায়ে যেতে পারে, তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে।’