অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

পাঠকের লেখা–৪৫

ফেলে আসা দিবা–রাত্রির কাব্য

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com

প্রত্যন্ত একটি গ্রাম ভাদড়া। উপজেলা চৌগাছা আর জেলা যশোর। আমি এই গ্রামেরই মেয়ে। যখনকার কথা লিখছি, তখন দিনে পুরো গ্রাম একবার চক্কর তো দিতামই। সারা দিন কই কই যে ঘুরে বেড়াতাম! খাওয়ার সময় হলে বাড়ি ফিরতাম।

কোনো কোনো দিন বলু দেওয়ানের মেলা থেকে কেনা নকশা করা মাটির হাঁড়িতে সবার বাড়ি থেকে তোলা চাল, ডাল আর ডিমে আমাদের সমবয়সীদের রান্নাবান্না চলত। সে বেলায় বাড়ি না ফিরলেও চলত।

আমার গ্রামটি ছিল বিদ্যুৎবিহীন। সন্ধ্যার পরেই নেমে আসত অন্ধকার। আমাদের চুন-সুরকির দালানটি ছিল সুশীতল। বাড়িতে তালা–চাবির প্রচলন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ধান-চালসহ অনেক কিছুই বাইরে থাকত। সন্ধ্যা হলেই আমার ভাই ও বোন হারিকেনের আলোতে উঠানে খেজুরপাতার মাদুরে বসে দুলতে দুলতে পড়ত। রাতে ঘরের বারান্দায় এক লাইনে বিছানা করে নিশ্চিন্তে আরাম করে ঘুমাতাম। ঘর খালি পড়ে থাকত।

গ্রীষ্মে পাখির কিচিরমিচির ভোরে একটু আলো ফুটতেই চোখ মুছতে মুছতে পুটে চাচার কুয়োতলার বড় আমগাছের তলায় গিয়ে হাজির হতাম। পুরোপুরি সকাল হলে তো আর পাকা আম পাওয়া যাবে না।

কালবৈশাখী ছিল আমার বড়ই প্রিয়। ঝড়ের সময় অন্ধকার হয়ে আসত, তার মধ্যেই দিতাম দৌড়। ফল ঝড়ের মধ্যেই বেশি পড়ত।

গ্রামে ছিল বড় একটা হিজল আর একটা বাবলাগাছ। সকালবেলা গোলাপি হিজল ফুল কার্পেটের মতো গাছের নিচে পড়ে থাকত, ফুলের কী সুবাস! গাছ দুটি এখন আর নেই। খুব মনে পড়ে।

শীতের দিনের স্বল্প আয়ুর বিকেলে গাছির সদ্য কেটে রাখা ছোট ছোট খেজুরগাছের রস পাটখড়ি দিয়ে স্ট্র বানিয়ে খেতাম। পাকা তেঁতুলের খোসার মধ্যে পানি আর চাল দিয়ে ছাই আগুনের মধ্যে বসিয়ে রাখলে টকটক ভাত হতো। কত যে মজা লাগত খেতে। মাঠে ছোলাশাক তোলা, গাছ পুড়িয়ে ফুটতে থাকা গরম–গরম ছোলা খাওয়া—সে এক শৈশব বটে।

পাড়ার ফুফু–চাচিদের দেখাদেখি বাড়ির পুকুরের সিঁড়িতে বসে চুল পরিষ্কার করতাম এঁটেল মাটি দিয়ে। তা শ্যাম্পুর চেয়ে কোনো অংশে কম কাজ করত না।

মেয়েবাচ্চাদের সাজসজ্জার একটা ব্যাপার তো থাকেই, এ ক্ষেত্রে পছন্দের তালিকায় ছিল নিজেদের তৈরি করা অলংকার; নারকেলপাতার ঘড়ি, চশমা আর বুনো পাতার হার। নারকেলপাতার ঘড়ি আর চশমাটা পরলে নিজের মধ্যে একটু অন্য রকম ভাব আসত বটে।

আব্বাকে হাটে যেতে দেখলে এক দৌড়ে হাত ধরে বসতাম। পাশের গ্রামে বসত হাট। কী কী কিনতেন দেখতাম। বাড়ি ফেরার আগে আব্বা রসমন্ডি, গজা, বাতাসা কিনে দিতেন।

গ্রামে বরফওয়ালা, কটকটিওয়ালা, বায়োস্কোপ আসত। বায়োস্কোপে রাজ্জাক, শাবানা, ববিতা, সুচন্দা, নূতন, জসীম, ওয়াসিমদের ছবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হতো। মা কৌটায় চাল দিতেন এগুলোর খরচ মেটানোর জন্য।

গ্রামে মায়েদের জন্য রান্নার মাপের এক কৌটা চাল দেওয়া হয়তো কোনো ব্যাপার ছিল না। আট আনা বা একটা টাকা দেওয়া কখনো কখনো কঠিন ছিল। চাল কিংবা টাকাপয়সা সব সময় মিলত, তা নয়। তবে খরচ তো আর থেমে থাকত না। তার জন্য ছোটবেলায় কিছু আয়ের পথ ছিল। পরিবারের সারা বছরের খাওয়া, বীজ ও অবশিষ্টাংশ বিক্রির জন্য পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হতো। পেঁয়াজ রাখা হতো গরুর গোয়ালের মাচার ওপর। গোয়ালের চালা ছিল ছনের।

শীতের শুরুতে সব পেঁয়াজ মাচা থেকে নামানো হতো। কিন্তু বড়রা সব পেঁয়াজ মাচা থেকে কুড়িয়ে আনতেন না। বাঁশের মাচার চিপাচাপা ও ফাঁকফোকরে আটকে থাকা পেঁয়াজ আমাদের ছোটদের কুড়াতে বলতেন। এই পেঁয়াজ যে যতটুকু কুড়াবে, সেটুকু তার। এই কাজ আমরা সানন্দে করতাম। বাজারে তাঁদের বিক্রির পেঁয়াজের সঙ্গে আমাদেরটাও পৃথকভাবে ওজন করতেন। সে টাকা আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হতো। 

আর একটা ঘটনা মনে আছে। আমাদের সময়ে পাটের বেশ ভালো দাম পেতেন কৃষকেরা। তখন আমাদের বলা হতো, পাটখড়ির গায়ে লেগে থাকা অবশিষ্ট আঁশ উঠিয়ে নেওয়ার জন্য। এই আঁশকে গ্রামের ভাষায় ‘ফেসো’ বলা হতো। ওই সময়টায় ফেসোও ভালো দামে বিক্রি হতো। এতে আমাদের কিছু আয় হতো।

বর্তমান প্রজন্মের সন্তানেরা বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে। কিন্তু একটুতেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। ফোন, ল্যাপটপের রঙিন কাচের স্ক্রিনটা সরে গেলে ওদের চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে।

অথচ ছোটবেলায় আমাদের কাজের অভাব ছিল না। একটা প্রজাপতি, জোনাকি, ফড়িং ধরা, ফড়িংয়ের লেজে সুতা বেঁধে তার পিছু পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে পার হতো কত সময়।

আফসোস হয়, আমাদের সন্তানদের প্রাণ–প্রকৃতির মায়ায় আবিষ্ট করার সম্পর্ক গড়ে দিতে পারিনি।

  • সারমিন সুলতানা, সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, সরকারি সা’দত কলেজ, টাঙ্গাইল