বঞ্চিত মানুষের পাশে সারা বছর

ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বিনা মূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ ও ওষুধ নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন এক নারী। গতকাল দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মানপুর হাফিজিয়া মাদ্রাসায়
ছবি: প্রথম আলো

‘মানবতার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা’ স্লোগান সামনে রেখে গাজীপুরে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন আয়োজন করে মেডিকেল ক্যাম্পের। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত এই ক্যাম্পে বিনা মূল্যে এক হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা পান।

দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াও এই ক্যাম্পে পাঁচজন বিদেশি চিকিৎসকও অংশ নেন। তাঁরা হলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিস্টিন উইরলো, কোরিয়ার জেসুন লি, ভারতের কামরান আলী, নেপালের নরেন্দ্র ভট্ট ও মিশা ভট্ট।

প্রত্যন্ত এলাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে ক্যাম্পের পাশাপাশি বছরজুড়েই নানা মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। বিনা মূল্যে চক্ষুশিবির, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। বন্যা ও করোনা মহামারিতে ত্রাণ বিতরণ, হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানো এবং জনগণের সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালানো হয়েছে ফারাজ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি পক্ষাঘাতগ্রস্তদের থেরাপির মতো নিয়মিত কার্যক্রমও চালু রয়েছে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের মানুষ। দুই বন্ধুকে ছেড়ে আসতে অস্বীকৃতি জানানোয় জঙ্গিদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। সাহসী এই তরুণের নামে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন গড়েছে তাঁর পরিবার। ফাউন্ডেশন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। ফারাজ আইয়াজ হোসেন বন্ধুত্ব, সাহস ও মানবিকতার যে নিদর্শন দেখিয়েছিলেন, সেই অনুভূতি ধারণ ও লালন করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর নামে গড়া ফাউন্ডেশন।

ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এসব মেডিকেল ক্যাম্পে নারী-পুরুষের সমস্যা শুনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা তাঁদের ব্যবস্থাপত্র দেন। বিনা মূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধও সরবরাহ করা হয়। মেডিকেল ক্যাম্পগুলোতে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অংশ নেন। জেনারেল ও ল্যাপরোস্কোপিক সার্জন অধ্যাপক রফিকুস সালেহীনের মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে ক্যাম্পে অংশ নেন।

সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনকেন্দ্র সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজডে (সিআরপি) চালু আছে ফারাজ হোসেন সেন্টার। এই কেন্দ্র বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের থেরাপি ও বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিদিন শতাধিক শিশু থেরাপি সুবিধা নিয়ে বেড়ে উঠছে।

শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতিভা থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে তা প্রকাশের সুযোগ মেলে না। শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ‘সাহস নিয়ে স্বপ্ন আঁকি’ শিরোনামে নিয়মিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে।

প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে চক্ষুসেবা পৌঁছে দিতে ডিস্ট্রেসড চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনালের (ডিসিআই) সঙ্গে কয়েক বছর ধরে নিয়মিত চক্ষুশিবিরের আয়োজন করে আসছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। চক্ষুশিবিরে বিনা মূল্যে চক্ষু পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে চশমার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, প্রয়োজনে চোখের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থাও করা হয়। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ৪০ জনের এবং নীলফামারীর ডোমারে ৬৫ জনের চোখের ছানি অপারেশন করা হয় ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে।

সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন ডিসিআইয়ের সহযোগিতায় সানসাইন স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও মাইক্রোওয়েভ ওভেন সরবরাহ করেছে।

এর আগে গত বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যায় খাবার ও সুপেয় পানির তীব্র সংকটের সময় বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। সিলেট, সুনামগঞ্জসহ শেরপুর, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, বগুড়া, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইলের বানভাসি কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চে। শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত জটিল রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিতে এগিয়ে আসে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। জেলা সদরসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬৫টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সরবরাহ করা হয়। করোনা মহামারিতে জনগণকে সচেতন করতে ‘সচেতনতায় শক্তি, সাহসিকতায় জয়’ স্লোগান সামনে রেখে আয়োজন করা হয় অনলাইন আলোচনার।

ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমের বিষয়ে ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেল বিনয় দাস প্রথম আলোকে বলেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের কথা বিবেচনায় না নিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করছে এই ফাউন্ডেশন। যেখানেই বঞ্চিত ও অসহায় মানুষ, সেখানেই কাজ করবে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। সাহসিকতা, বন্ধুত্ব আর মানবতার প্রতি ফারাজের মূল্যবোধ সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে এই ফাউন্ডেশন।