প্রতিবাদ করেই যাব: ফুলপরী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন
ছবি: প্রথম আলো

সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিট! ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ ভবন থেকে বেরিয়ে তদন্ত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসলেন ফুলপরী। এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা যদি আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারও সঙ্গে করা হয়, আপনি কী করবেন?’

জবাবে ফুলপরী বলেন, ‘আশা করি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটবে না। যদি ঘটে, আমি আমার অবস্থানেই থাকব এবং সব সময় প্রতিবাদ করেই যাব।’

এরপর গাড়ি চলে যায় দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ভেতর, যেখানে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ফুলপরী খাতুন। এর আগে গতকাল বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট থেকে ৬টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত প্রক্টর শাহাদৎ হোসেনের কার্যালয়ে ফুলপরীর সঙ্গে কথা বলেন হাইকোর্টের নির্দেশে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

এ কমিটির সদস্যরা হলেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আ ন ম আবুজর গিফারী, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদা সুলতানা এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর শাহাবুব আলম। গত রোববার রাতে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক এই কমিটি গঠন করেন।

১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে তাঁকে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেন ফুলপরী। তাঁর ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল এবং এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেই কমিটির সদস্যরাই গতকাল ফুলপরীর বক্তব্য শোনেন।

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে তদন্ত কমিটি প্রক্টর কার্যালয়ে যায়। সেখান থেকেই ফুলপরীকে আসতে বলা হয়। ফুলপরী তাঁর বাবা আতাউর রহমান ও ভাই হযরত আলীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। পাবনার শিবপুর গ্রাম থেকে বাবার ভ্যানে করে ৩০ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলার চরসাদী খেয়াঘাট এলাকায় আসেন। এরপর নৌকায় এক ঘণ্টায় পদ্মা পাড়ি দিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটায় শিলাইদহ খেয়াঘাটে পৌঁছান। সেখানে আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা কুমারখালী থানার ওসি মহসীন হোসাইন তাঁদের গাড়িতে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন।

দুই ঘণ্টা ধরে ফুলপরীর সঙ্গে একান্তে কথা বলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এ সময় তাঁর বাবা ও ভাই পাশের কক্ষে বসা ছিলেন। তদন্ত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে ফুলপরী, তাঁর বাবা ও ভাই একসঙ্গে বের হন। এ সময় তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে জানানো হয়, আদালতের বিষয় জড়িত থাকায় তাঁরা কোনো মন্তব্য করবেন না।

এরপর ফুলপরী গণমাধ্যমের সামনে সংক্ষিপ্ত কথা বলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফুলপরী বলেন, ‘পুরো ঘটনা জানতে চেয়েছেন তাঁরা। আমি পুরো ঘটনাটাই বলেছি। আমি সর্বোচ্চ বিচার দাবি করেছি।’ এরপর তাঁকে তদন্ত কমিটির সদস্যরা তাঁদের গাড়িতে করে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ভেতরে নিয়ে যান।

জানতে চাইলে রাত সাড়ে সাতটার দিকে হলের শাখা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ফুলপরীকে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা ঘটনার সব জায়গা ঘুরে দেখেন। তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা শোনেন; এবং সেসব রুমের ছাত্রীদের নাম, ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর লিখে নেন। আগামীকাল (মঙ্গলবার) অভিযুক্ত নেত্রীসহ হলের অন্য ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলবেন তাঁরা।

ফুলপরীর বড় ভাই হযরত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌকায় করে পথে আসতে অনেক সমস্যা হচ্ছে। তারপরও আসছি। সময় ও খরচের বিষয়ও আছে। যত রাতই হোক বাড়ি ফিরতে হবে।’

ছাত্রলীগের দুই নেত্রীও এসেছিলেন

নির্যাতনে অভিযুক্ত দুই নেত্রী সানজিদা ও তাবাসসুম গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল তদন্ত কমিটির কার্যালয়ে পৃথকভাবে বক্তব্য দিয়েছেন। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সানজিদা ও তাবাসসুম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা তদন্ত কমিটির ডাকে কমিটির আহ্বায়ক আইন বিভাগের অধ্যাপক রেবা মণ্ডলের কার্যালয়ে যান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রথমে সানজিদাকে সকাল সাড়ে নয়টায় কক্ষে ডাকা হয়। এরপর বেলা সাড়ে ১১টায় বেরিয়ে পাশের রুমে বসেন তিনি। সানজিদা বের হওয়ার পর তাবাসসুম দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রেবা মণ্ডলের কক্ষে প্রবেশ করেন। তিনি দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে বের হন। এরপরই আবার ওই কক্ষে সানজিদা প্রবেশ করেন এবং বেলা ১টা ২০ মিনিটে বের হন। আবার তাবাসসুমও বেলা ১টা ২৫ মিনিটে প্রবেশ করে ২টায় বের হন।

এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা সানজিদাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। প্রথমে তিনি কথা বলতে চাননি। একপর্যায়ে সানজিদা বলেন, ‘তদন্ত কমিটির সঙ্গে প্রথমে একবার কথা হয়েছে। এরপর চার পৃষ্ঠার লিখিত দেওয়া হয়েছে। ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত কমিটি জানতে চেয়েছে। তদন্ত হচ্ছে, তদন্তের মাধ্যমেই সবকিছু জানতে পারবেন।’

এ সময় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আপনি হলে ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। জবাবে সানজিদা বলেন, ‘তদন্ত করলেই সবকিছু জানতে পারবেন। প্রতিবেদন যা আসবে সত্যিটাই তো আসবে।’

ছাত্রলীগের পদ পেলেন কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে সানজিদা বলেন, ‘কমিটিতে আসা বা না আসা আমার কমেন্ট করার কথা নয়। আপনারা বড়দের সঙ্গে কথা বলেন, সবকিছু জানতে পারবেন।’ হলে ফুলপরীকে নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সানজিদা চৌধুরী বলেন, ‘নো কমেন্ট।’

আরেক নেতা তাবাসসুম বললেন, ‘যা বলার তদন্ত কমিটির কাছে বলেছি, এর বাইরে কিছু বলতে চাই না।’

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক রেবা মণ্ডল সাংবাদিকদের বলেন, ‘তদন্ত কমিটির কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য এসব বাইরে প্রকাশ করার বিধান নেই। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করার চেষ্টা করব।’