শিশুর জন্য সামাজিক সুরক্ষা

শিশু সুরক্ষায় বড় লক্ষ্য, বরাদ্দ নামমাত্র

সীমিত এলাকায় চলছে কর্মসূচি। ফলে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মা ও শিশু কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে।

অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় কাজ করছে শিশুরা। রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকায়
ফাইল ছবি

সুরমা-সুলতান দম্পতির দুই সন্তান। রাজধানীর কল্যাণপুরে পোড়া বস্তিতে থাকেন। তাঁদের বড় মেয়ে ফাহিমার বয়স ৮ বছর। তবে লিকলিকে গড়নের ফাহিমাকে দেখতে ৫–৬ বছরের বেশি মনে হয় না। ছেলে রমজান দুগ্ধপোষ্য। ছোট সন্তান গর্ভে থাকতে সুরমা ‘মা ও শিশু সহায়তা’ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হন।

গত ১৮ জুন সুরমার (২৬) সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী রিকশাচালক। করোনার শুরুতে তাঁরা দুই বেলার বেশি খেতে পারতেন না। মেয়েটিও ঠিকমতো খাবার না পাওয়ায় ‘চিকন-চাকন’। এখন মাসে ৮০০ টাকা ভাতা পাচ্ছেন। তা দিয়ে ছেলের জন্য দুধ-কলা কেনেন।

তবে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) না থাকায় ভাতা পান না তাঁর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী চম্পা (২০)। তাঁর সন্তানের বয়স এখন এক মাস।

বস্তির ৩ নম্বর গলির চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা নূপুরও (২৭) মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচিতে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তবে তাঁর বড় বোন খালেদা অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালে চেষ্টা করেও তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে যাচাই–বাছাইয়ের সময় কেউ একজন ‘শত্রুতা’ করে বলেছে, খালেদার এটি তৃতীয় সন্তান।

শিশুপুষ্টির সবচেয়ে বড় কর্মসূচি

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত শিশুপুষ্টির জন্য সরকারের সবচেয়ে বড় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি হচ্ছে ‘মা ও শিশু সহায়তা’ কর্মসূচি। তবে সব এলাকায় না থাকায় বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মা ও শিশু কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি দুইয়ের বেশি সন্তানের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা, বাল্যবিবাহ রোধ, এনআইডির শর্ত থাকায় অনেকে বাদ যাচ্ছেন। অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শর্ত পূরণ না করায় চার বছরে ২০ হাজারের বেশি আবেদন বাতিল হয়েছে।

২০২১ সালের আগস্টে বিশ্বব্যাংক ‘বাংলাদেশ সোশ্যাল প্রোটেকশন পাবলিক এক্সপেনডিচার রিভিউ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতের ব্যয় পর্যালোচনা করে জানায়, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। অথচ তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় ২ শতাংশের কম। বয়স্ক জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হলেও তাঁদের জন্য এই খাতে ব্যয় হয় ৭২ শতাংশ।

শিশুপুষ্টির বাইরে অন্য খাতেও বরাদ্দ কম

১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিশুদের নিয়ে কাজ করে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘অ্যালোকেশন ফর চিলড্রেন ইন পাবলিক এক্সপেনডিচার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০২১-২২ অর্থবছরে ওই সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাত্র ১৩ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ব্যয় হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু পুষ্টি নয়, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক সুরক্ষা খাতে শিশুদের জন্য বরাদ্দ সামান্য। এই সামান্য বরাদ্দ দিয়ে বড় লক্ষ্য পূরণ সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শিশু বাজেট প্রতিবেদন ২০১৯-২০ অনুসারে, দেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ।

মাত্র ১৫ শতাংশ ইউনিয়ন কর্মসূচির আওতায়

গ্রামীণ এলাকায় ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ (২০০৭ সাল) এবং শহরে ‘কর্মজীবী মায়েদের জন্য ল্যাকটেটিং ভাতা’ (২০১০ সাল) কর্মসূচিকে সমন্বিত করে ২০১৯ সালে ‘মা ও শিশু সহায়তা’ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ৬৮টি উপজেলার ৬৬৯টি ইউনিয়ন পরিষদ এবং ঢাকা উত্তর, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনসহ ৪৪টি শহর এলাকায় এ কর্মসূচি চালু আছে। কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ লাখ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১২ লাখ ৫৪ হাজার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

রাজধানীতে শুধু কল্যাণপুরে এ কর্মসূচি চালু আছে। তা–ও মাত্র ৯ মাস আগে শুরু হয়েছে। কল্যাণপুর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের কর্মী শামীম আরা প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত ৮ মাসে ১২২ মা তালিকাভুক্ত হয়েছেন। শর্ত পূরণ না করায় ৫০ জন বাদ পড়েছেন।

ভাতাভোগী দরিদ্র মায়েরা এই অর্থ পুষ্টির পেছনে খরচ করছেন কি না, তা নিয়ে নজরদারির কোনো ব্যবস্থা নেই। কল্যাণপুর বস্তির ভাতাভোগী ঝরনা বেগম (২৫) বলেন, ‘অভাবের সংসার, কিছু টাকা তো সংসারের জন্য খরচ হয়েই যায়।’

কর্মসূচি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা

কর্মসূচি নিয়ে বড় পরিকল্পনার কথা জানিয়ে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মসূচি পরিচালক (মাতৃত্বকালীন ভাতা) রুবিনা গনি প্রথম আলোকে বলেন, মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে শিশুর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ এক হাজার দিন পুষ্টির চাহিদা পূরণে এটিই প্রধান কর্মসূচি। ২০২৬ সালের মধ্যে চার বছর বয়স পর্যন্ত ৬০ লাখ শিশুকে এই কর্মসূচির আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। শিগগিরই সব সিটি করপোরেশন কর্মসূচির আওতায় আসবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘের শিশু তহবিলের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাসটার সার্ভে–২০১৯ অনুসারে, দেশে খর্বকায় শিশুর হার ২৮ শতাংশ, কম ওজনের শিশুর জন্মহার প্রায় ২৩ শতাংশ এবং কৃশকায় প্রায় ১০ শতাংশ।

শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, সহিংসতা রোধে বরাদ্দ ১ শতাংশ

১৬ বছর বয়সী নিজাম (ছদ্মনাম) রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের নুরবাগ এলাকায় একটি অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় কাজ করে। গত ৮ জুন কথা হয় নিজামের সঙ্গে। সে জানায়, তাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালি উপজেলায়। ২০১৬ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল ছেড়ে দেয় সে। গত বছর নদীতে ঘর ভেঙে গেলে সংসারের অভাব–অনটনের মধ্যে সে ঢাকায় এসে অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় পলিসের কাজ নেয়।

বিবিএসের তথ্যমতে, নিজামের মতো প্রায় ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত। শ্রমে যুক্ত প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু।

নুরবাগের কাছাকাছি কালারবাড়িতে ২৫টি পরিবারের বসবাস। একেকটি পরিবার শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের উদাহরণ। এক গৃহবধূ (৪৫) প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী কাজ করেন না। তিনি শিশুপুত্রকে নিয়ে একটি প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করেন। আর মেয়েকে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন।

মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাসটার সার্ভে অনুসারে, দেশে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়। ১৫ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয় ১৫ শতাংশের।

২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ নির্মূল এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ এক-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্য ছিল সরকারের। ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল ও ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য রয়েছে।

এক শিশুর রিকশাচালক বাবা প্রথম আলোকে বলেন, করোনার আগে তাঁর ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। আয় কমে যাওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে সন্তানকে প্লাস্টিক কারখানায় কাজে দেন।

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) ‘র‌্যাপিড অ্যানালাইসিস অব চাইল্ড ম্যারেজ সিচুয়েশেন ডিউরিং কোভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১৩ হাজার ৮৮৬টি মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছে।

সংস্থার ‘শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের সুরক্ষা কর্মসূচি (পিডব্লিউসি)’ শীর্ষক আরেক জরিপে বলা হয়, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত নতুন করে ৭ হাজার ৮০০ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে।

করোনাকালের এই পরিস্থিতির কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি গত অর্থবছরের বাজেটে।

৮ জুন প্রকাশিত সিপিডির ‘অ্যালোকেশন ফর চিলড্রেন ইন পাবলিক এক্সপেনডিচার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে শিশুদের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ব্যয় বিশ্লেষণ করে জানায়, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা রোধে ১৫টি মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ ছিল মাত্র ১ শতাংশ।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে একটি প্রকল্পে যুক্ত যুগ্ম সচিব ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের জন্য বাজেট কম, এটা সত্যি। তবে সরকার এই বাজেট বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে।

করোনাকালে সমস্যা বাড়লেও উদ্যোগ কম

রাজধানীর কুড়িল কুড়াতলী বাজারের পকেটগেট এলাকার বাসিন্দা শিউলী (ছদ্মনাম) গৃহকর্মীর কাজে যুক্ত। স্বামী অসুস্থ হয়ে গ্রামে চলে গেছেন। খরচের চিন্তায় পাঁচ সন্তানের দুজনকে ঢাকায় রেখে বাকিদের গ্রামে পাঠিয়ে দেন। সবার বড় ১৪ বছরের ছেলেকে গত জুনে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজে দেন। করোনার আগে ছেলেটি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত।

সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কোভিডে মা-বাবা হারিয়ে ১০ হাজারের বেশি শিশু এতিম হওয়ায় নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে। স্কুল থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, শিশুর প্রতি সহিংসতার পুরোনো সমস্যা বেড়েছে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট প্রকল্প নেওয়া জরুরি। সে রকম কিছু সরকারি কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে না।

মার্চে পরিকল্পনা কমিশন প্রকাশিত ‘সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ২০২১-২০২২’ প্রতিবেদন অনুসারে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে (বিনিয়োগ ও কারিগরি) চার মন্ত্রণালয়ের ১ হাজার ৮০৭ কোটি টাকার ৬৫টি প্রকল্পের মধ্যে ১৬টি শিশুদের জন্য ছিল।

ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্প বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৩৪টি প্রকল্পের মধ্যে শিশুদের জন্য ১১টি, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২৫টির মধ্যে ৫টি, স্বাস্থ্য খাতের ৭৪টির মধ্যে ১৭টি, শিক্ষা খাতের ১২৫টির মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১২টি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ৭৮টির মধ্যে ৫টি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের ১৫টি প্রকল্পের ১টি শিশুদের জন্য ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের ওপর বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সুফল পাওয়া যায়। এ কারণে শিশুদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় অন্তত ২৫ শতাংশ করা উচিত। পুষ্টির বিষয়ে শিশুদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি শুধু দরিদ্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সর্বজনীন করা দরকার।