আধুনিক জীবনে ফ্রিজ আশীর্বাদস্বরূপ। ফ্রিজের কারণে জীবন হয়েছে স্বস্তির। প্রতিদিনের বাজার করা, রান্না-খাওয়া এবং খাবার সংরক্ষণের কাজটি সহজ করে দিয়েছে এই ফ্রিজ। তবে সংসারের গুরুত্বপূর্ণ এ যন্ত্রটি প্রায়ই হয়ে ওঠে বিড়ম্বনার কারণ।
অনেক সময় দেখা যায়, ফ্রিজ খুললেই ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গন্ধ। কিংবা ফ্রিজ খুললেই নাকে ঝাপটা দেয় মিশ্র খাবারের উৎকট গন্ধ। এমনটা কেন হয়, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল সরকারি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের গৃহায়ণ ও গৃহব্যবস্থাপনা বিষয়ের অধ্যাপক রিনাত ফৌজিয়ার কাছে। তিনি বলেন, ফ্রিজ থাকা মানে বাড়তি রান্নার চাপ থেকে মুক্ত থাকা। রান্না ও কাঁচা সব রকম খাবারই ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়। এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটা সঠিকভাবে না করার জন্য কখনো কখনো ফ্রিজে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। এর ফলে ফ্রিজে রাখা খাবার নষ্টও হতে পারে। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ফ্রিজ দুর্গন্ধমুক্ত রাখতে করণীয় সম্পর্কে রিনাত ফৌজিয়া জানান, ফ্রিজে যেন কোনো রকম দুর্গন্ধ না ছড়ায়, সে জন্য এর তাপমাত্রার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফ্রিজের ‘নরমাল’ অংশের তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে হবে। আর ডিপ ফ্রিজের তাপমাত্রা রাখতে হবে মাইনাস ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর কাছাকাছি। ফ্রিজের খাবারের পরিমাণের ওপরও নির্ভর করে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা। সবজি-ফলমূল ইত্যাদি কাঁচা খাবার খোলা না রেখে আলাদা আলাদা ছোট জিপার ব্যাগে রাখতে হবে। ডিপ ফ্রিজে কাঁচা মাছ–মাংস অবশ্যই আলাদা আলাদা প্যাকেটে রাখতে হবে। এভাবে নিয়ম মেনে গুছিয়ে রাখলে গন্ধ ছড়াবে না।
রান্না করা খাবার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাটি ঢাকনাবিহীন হলে প্লাস্টিকের র্যাপ দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় মুখবন্ধ বায়ুরোধী পাত্রে রাখলে। ‘ফ্রোজেন ফুড’ বা হিমায়িত খাবার কখনো কাঁচা মাছ-মাংসের সঙ্গে রাখা যাবে না। কাটা পেঁয়াজ-রসুন ফ্রিজে রাখলে দুর্গন্ধের পাশাপাশি বিষক্রিয়ার ঝুঁকিও থাকে। তাই এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
দুর্গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিজে রাখা খাবার কীভাবে জীবাণুমুক্ত রাখা যায়, তা নিয়ে পরামর্শ দেন ইলেক্ট্রা ইন্টারন্যাশনালের পণ্যব্যবস্থাপক মো. রাশেদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ফ্রিজে যেহেতু নানা রকম খাবার এক জায়গায় রাখা হয়, তাই এ থেকে জীবাণু ছড়ায় খুব সহজেই। সময়মতো ফ্রিজ পরিষ্কার না করলে ফ্রিজে বাসা বাঁধা জীবাণু খাবার নষ্ট করে দেয়। ফ্রিজ খুব ময়লা হয়ে গেলে ১৫ দিনে একবার নয়তো মাসে একবার অবশ্যই ফ্রিজ পরিষ্কার করতে হবে। নিয়মিত ফ্রিজ পরিষ্কার করলে জীবাণু আক্রমণ করতে পারবে না।’
পরিষ্কার না থাকলে ফ্রিজে স্যালমোনেলিয়াস ই-কোলাই এবং লিস্টেরিয়ার মতো ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধতে পারে। তাই মাসে অন্তত এক দিন গরম পানিতে ডিটারজেন্ট গুলিয়ে নরম কাপড় বা স্পঞ্জ ভিজিয়ে ফ্রিজ পরিষ্কার করতে হবে। ফ্রিজ পরিষ্কারের পর তাতে তাজা লেবু ফালি করে রাখতে পরামর্শ দেন মো. রাশেদুজ্জামান। এতে করে জীবাণুর আক্রমণ এবং দুর্গন্ধ দুটো থেকেই রেহাই পাবে ফ্রিজ।
ক্রস-কন্টামিনেশন বলতে মূলত একাধিক খাবারের ক্ষুদ্র খাদ্যকণা ও জীবাণু মিশে যাওয়া বোঝায়। সাবধান না হলে ফ্রিজের বদ্ধ পরিবেশে এটা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। অনেককেই দেখা যায়, কাঁচা মাংস খোলা অবস্থায় রেফ্রিজারেটরে রেখে দেন, ফলে মাংসের ক্ষুদ্রকণা রেফ্রিজারেটরের ভেতরে থাকা অন্য খাবারে মিশে যায়। ফ্রিজে সংরক্ষিত খাবারের এমন দূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্রস-কন্টামিনেশন এড়াতে কাঁচা মাংস, মাছ এবং কাঁচা সবজি ও ফলমূল প্রতিটি আলাদাভাবে নিরাপদে বক্সে বা ব্যাগে মুড়িয়ে রাখতে হবে।
পানীয় এবং পচনশীল খাবার কুলারে আলাদাভাবে প্যাক করতে হবে। দুগ্ধজাত খাবার রাখার সময় ভালোভাবে সিল করে রাখতে হবে। কারণ, এ খাবারগুলোতে জীবাণু খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ফ্রিজের তাপমাত্রায় কোনো জীবাণুই সেভাবে সক্রিয় থাকে না। তবে শাকসবজি ইত্যাদি ধুয়ে ফ্রিজে রাখা উচিত। ধোয়া না থাকলে এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া লেগে থাকে। এর থেকেও সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করা ও ফ্রিজে রাখার সময় হাত পরিচ্ছন্ন থাকা উচিত। হাত থেকেও জীবাণু সংক্রমণ ছড়াতে পারে। ছোট ছোট এসব সচেতনতাই পারে দুর্গন্ধহীন ও জীবাণুমুক্ত ফ্রিজের নিশ্চয়তা দিতে।