জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একমত, বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ

মন্ট্রিয়লে কপ-১৫ সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সবাই মতৈক্যে পৌঁছেছে। লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয়েছে। তবে অর্থায়ন নিয়ে ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতপার্থক্য রয়ে গেছে।

কুনমিং-মন্ট্রিয়েল গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ফ্রেমওয়ার্ক পাসের পর জাতিসংঘ-সমর্থিত কপ-১৫ নেতারা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। গত সোমবার সম্মেলনের শেষ দিনে কানাডার মন্ট্রিয়লে

কানাডার মন্ট্রিয়লের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত প্যালে ডে কংগ্রেস কনভেনশন সেন্টারের বাইরে তখন বেশ তুষারপাত হচ্ছিল। বাইরে তীব্র ঠান্ডা থাকলেও ভেতরে কপ-১৫ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিদের আলোচনায় বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। মতৈক্যে পৌঁছাতে তাঁরা এক বৈঠক থেকে অন্য বৈঠকে যাচ্ছিলেন।

দিন গড়িয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত আলোচনা চলতে থাকে। অনেক দর-কষাকষির পর স্থানীয় সময় গত সোমবার ভোররাতে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্ত করেন তাঁরা। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর এক–তৃতীয়াংশ রক্ষায় সবাই সম্মত হন।

আলোচনায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল—জীববৈচিত্র্য ফ্রেমওয়ার্ক কতটা উচ্চাভিলাষী হওয়া উচিত, কীভাবে অর্থায়ন করা হবে এবং কীভাবে অগ্রগতি মূল্যায়ন ও স্বচ্ছ প্রতিবেদন নিশ্চিত করা যায়।

৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ–সংক্রান্ত ১৫তম কনফারেন্স অব পার্টিস (কপ-১৫) শুরু হয়। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে টানা আলোচনার পর ১৯ ডিসেম্বর সম্মতি মিলল। চার বছরের বেশি সময় ধরে আলোচনার পর প্রায় ২০০টি দেশ ‘কুনমিং-মন্ট্রিয়ল গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ফ্রেমওয়ার্কে’ সায় দিল।

চীনের সভাপতিত্বে কানাডায় আয়োজিত সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ২০৩০ সালের মধ্যে চারটি অভীষ্ট ও ২৩টি লক্ষ্যমাত্রা–সংবলিত ফ্রেমওয়ার্ক গ্রহণ করা হয়েছে।

চীন প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের একটি বড় পরিবেশ চুক্তিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। চীনের কুনমিং শহরে সম্মেলন শুরু হয়েছিল। পরে কোভিড–১৯ বিধিনিষেধের কারণে সম্মেলন কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে স্থানান্তর করা হয়।

২৩টি লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ ভূমি ও জলভাগ সংরক্ষণ। বর্তমানে ১৭ শতাংশ ভূমি ও ১০ শতাংশ সামুদ্রিক অঞ্চল সুরক্ষিত। ২০৩০ সালের মধ্যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিভিন্ন উৎস থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলার জোগাড় এবং প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকি সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। অর্থায়ন প্যাকেজের অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোকে বছরে কমপক্ষে ২০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার আশ্বাস রয়েছে। বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই অর্থায়ন প্রতিবছর ৩০ বিলিয়ন ডলার করে বাড়বে।

কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, প্লাস্টিক বর্জ্যে সমুদ্রে লবণাক্ততা বাড়ছে, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের অত্যধিক ব্যবহার হচ্ছে, জনসংখ্যা ৮oo কোটি ছাড়িয়েছে এবং কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে—এমন এক বাস্তবতায় মন্ট্রিয়লে এই সমঝোতা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়িত হলে কৃষি, ব্যবসার সরবরাহব্যবস্থা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিকায় বড় পরিবর্তন আসতে পারে।

বিশ্বের শুধু দুটি দেশ—ভ্যাটিকান ও যুক্তরাষ্ট্র জীববৈচিত্র্য–সম্পর্কিত জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগ দেয়নি। ওয়াশিংটন ৩০ বছরের পুরোনো এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু তখনকার সিনেট এটি অনুমোদন করেনি। এটা লজ্জা ও উদ্বেগজনক। প্রকৃতির প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বিশেষ জীববৈচিত্র্য দূত নিয়োগ দিয়েছে। মন্ট্রিয়লে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই দূতকে ‘প্রভাবক’ ভূমিকায় দেখা গেছে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) উত্তর বিশ্বের প্রধান খেলোয়াড়ের ভূমিকায় ছিল। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের মতো সমালোচনা ও ভণ্ডামির অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছিল।

১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য কনভেনশন গৃহীত হয়। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে নির্দিষ্টসংখ্যক দেশ স্বাক্ষরের পর আন্তর্জাতিক চুক্তিটি কার্যকর হয়। এই চুক্তিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্যের উপাদানের টেকসই ব্যবহার এবং জেনেটিক সম্পদ ব্যবহার থেকে প্রাপ্ত সুবিধা সমানভাবে ভাগ করার কথা বলা হয়েছিল। এযাবৎ ১৯৬টি দেশের স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই চুক্তি মোটামুটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

প্রতিটি দেশ এবং এতে অংশগ্রহণকারী অন্য অংশীজনেরা যা চেয়েছিল, মন্ট্রিয়ল সম্মেলনে তার কিছুটা হলেও পেয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ঘাটতি লক্ষণীয়। ২০৫০ সালের সময়সীমা যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী নয়। কেউ কেউ ভর্তুকির বিষয়ে কঠোর অবস্থান চেয়েছিলেন। ভর্তুকির কারণে বিশ্বের অনেক অঞ্চলে খাদ্য ও জ্বালানি অনেক সস্তা। সমঝোতায় শুধু ২০২৫ সালের মধ্যে ভর্তুকি চিহ্নিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এরপর ২০৩০ সালের মধ্যে সেগুলো সংস্কার বা পর্যায়ক্রমে কমানো ও বন্ধ করার জন্য কাজ করা যেতে পারে।

২০৩০ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ৫ শতাংশ বৃদ্ধির বিষয়টি চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রায় স্থান পায়নি। একে একটি বড় সুযোগ হাতছাড়া বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা না থাকলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হারিয়ে যায়। পশ্চিমা ধনী দেশগুলোর ভোগ মোকাবিলায় লক্ষ্যমাত্রা নেই। তাদের এই ভোগব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সীমিত সম্পদ গ্রাস করছে। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে কার্বন উৎপাদন করছে।

সিনথেটিক বায়োলজি ও বায়োটেকনোলজির সমস্যা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার উত্থাপিত বেশ কয়েকটি উদ্বেগ অমীমাংসিত রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, সিনথেটিক বায়োলজির দিগন্ত স্ক্যানিং, প্রযুক্তি মূল্যায়ন ও নিরীক্ষণ, আর্থসামাজিক প্রভাব যাচাই এবং জিন ড্রাইভের ওপর বিশ্বব্যাপী স্থগিতাদেশ–সংবলিত কোনো জৈবপ্রযুক্তি–সম্পর্কিত লক্ষ্যমাত্রা নেই।

সদস্যদেশগুলোর অগ্রগতি প্রতিবেদন যাচাই করতে জলবায়ু পরিবর্তন–সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তির অনুরূপ একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷

৩০x৩০ (সংরক্ষিত বনাঞ্চল বোঝাতে ব্যবহার করা হয়) একটি শিরোনাম। কিন্তু এটি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রক্রিয়া ছাড়া অর্জন করা যাবে না। জীববৈচিত্র্য রক্ষার কোনো পদক্ষেপে আদিবাসীদের ওপর অভিঘাত ফেলে এমন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে আগে তাদের সম্মতি থাকতে হবে। অন্যথায় সংরক্ষিত এলাকায় আদিবাসীদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার একই পুরোনো প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।

অর্থায়ন আলোচনা দেরিতে শুরু

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দরিদ্র্য দেশগুলোকে অর্থায়নের আলোচনা দেরিতে শুরু হয়। এতে জটিল পরিস্থিতির ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল। বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশ প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে দেয়নি। তাঁরা জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি নতুন তহবিল গঠন করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিদ্যমান ‘গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাসিলিটির’ অধীনে এই তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

এরপরও যখন ২০২০-পরবর্তী গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ফ্রেমওয়ার্ক গৃহীত হতে যাচ্ছিল, তখন কঙ্গো উঠে দাঁড়িয়ে বিরোধিতা করেছে। কারণ, এতে ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার বিশেষ জীববৈচিত্র্য তহবিল গঠনের কথা উল্লেখ নেই৷ কপ-১৫ সম্মেলনের সভাপতি চীনের পরিবেশমন্ত্রী হুয়াং রুনকিউ কঙ্গোর বিরোধিতাকে আমলে নেননি।

কনভেনশনের আইন–বিশেষজ্ঞ রুলে বলেন, কঙ্গো আগে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি তোলেনি। বিষয়টি নিয়ে ক্যামেরুন, উগান্ডাসহ বেশ কয়েকটি আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর পক্ষে অবস্থান নিলেও কোনো লাভ হয়নি। তবে এসব দেশের প্রতিনিধিরা বলেছেন, তাঁরা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেশ করবেন।

সম্মেলনে সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর অন্যতম ছিল অর্থায়ন। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার ৭০টি দেশের প্রতিনিধিরা গত বুধবার আলোচনা থেকে বেরিয়ে যান। বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম চিরহরিৎ বন (রেইনফরেস্ট) ও বৃহৎ জীববৈচিত্র্যের দেশ ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, কঙ্গোসহ বিশ্বের দক্ষিণের দেশগুলো একটি নতুন জীববৈচিত্র্য তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেছিল।

অবশ্য কয়েক ঘণ্টা পর তাঁরা ফিরে আসেন। তাঁদের সম্মেলন থেকে এই বেরিয়ে যাওয়াটা আস্থার সংকটের লক্ষণ। উন্নয়নশীল দেশগুলো ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হতে পারছে না। তারা ২০২০-পরবর্তী গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নে আরও অর্থ দেওয়ার দাবি করেছিল।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কী পরিমাণ তহবিল দরকার এবং ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতির মধ্যে ব্যবধান বিশাল। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রয়োজন প্রায় ৭০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ১৭ বিলিয়ন ডলারের তহবিল করা হয়েছে। ধনী দেশগুলো লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কথা বলতে খুশি। কিন্তু এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তারা কত অর্থায়ন করবে, সেই প্রশ্ন এলে তারা নীরব থাকে।

আদিবাসীরা সমান মর্যাদা পায়নি

পৃথিবীর অর্ধেক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রকৃতিনির্ভর। মন্ট্রিয়লে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে রেকর্ড হয়েছে। সম্মেলনে ৪১টি কোম্পানির ৯০০ প্রতিনিধি ছিলেন। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বিশ্ব পরিবেশ নীতিগুলোকে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। কারও কারও মতে, দর-কষাকষিতে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের উপস্থিতি আলোচনার বৈধতাকে নষ্ট করে দেয়।

সম্মেলনে কোম্পানির প্রতিনিধিরা লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের তদবিরের কারণে জীববৈচিত্র্যের ওপর কোম্পানিগুলোর অভিঘাত প্রকাশ বাধ্যতামূলক না করে বরং উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। কোম্পানিগুলো তাদের গ্রিন ক্রেডেনশিয়াল নানা অতিকথনের মাধ্যমে উত্থাপন করেছে। সমালোচকেরা তাদের প্রতিশ্রুতির অত্যুক্তিকে ‘গ্রিন ওয়াশিং’ বলে অভিহিত করেন।

জাতিসংঘের মতে, পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ভূখণ্ডের প্রায় ২০ শতাংশে আদিবাসী মানুষের বসবাস। বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের প্রায় ৮০ শতাংশ রয়েছে তাদের বসতি অঞ্চলে। সম্মেলনে আদিবাসীরা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নেতা হিসেবে স্বীকৃত হলেও আলোচনায় তারা সমান মর্যাদা পায়নি। কারণ, কোনো কিছুতেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার মর্যাদা আদিবাসী জাতির নেই।

দরকার সমন্বিত পদক্ষেপ

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি, দূষণ ও তথাকথিত উন্নয়ন জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে। ১০ লাখ উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি কয়েক দশকের মধ্যে বিলুপ্তির শঙ্কায়। ক্ষতির হার এক হাজার গুণ বেশি। মানুষ নিয়মিত প্রায় ৫০ হাজার বন্য প্রজাতি ব্যবহার করে। বিশ্বের ৮০০ কোটি মানুষের প্রতি পাঁচজনের একজন খাদ্য ও আয়ের জন্য কোনো না কোনো প্রজাতির ওপর নির্ভরশীল।

জলবায়ু পরিবর্তন–সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে ২০৩০
সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি মানুষের সৃষ্টি ‘যমজ সংকট’। একটির সমাধান না করে আরেকটির সমাধান সম্ভব নয়।

আইনের প্রয়োগ, ক্ষমতাশীলদের আজ্ঞাবহ নয়

বহু বিজ্ঞানীর হুঁশিয়ারির পর মন্ট্রিয়ল ফ্রেমওয়ার্ক হলো। মানুষ নিজেকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তির সূচনা করেই চলছে। ডাইনোসরদের বিলুপ্তির চেয়ে বড় ক্ষতির দিকে যাত্রা করছে মানুষ। ২৩টি লক্ষ্যমাত্রা জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি রোধে পর্যাপ্ত নয়। অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

ফ্রেমওয়ার্ক আইনত বাধ্যতামূলকও নয়। ফলে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ রয়েছে। বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার রেকর্ড ভয়ংকর। বিগত দশকগুলোয় সরকার প্রকৃতি রক্ষার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা কখনো পূরণ করতে পারেনি৷ ২০১০ সালে জাপানের আইচিতে নির্ধারিত ২০টি লক্ষ্যমাত্রার একটিও অর্জিত হয়নি।

নতুন লক্ষ্যমাত্রাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নতুন আইন জরুরিভাবে প্রয়োজন। যেমন বাংলাদেশে প্রচলিত বন আইন ঔপনিবেশিক, সেকেলে। ঔপনিবেশিক বাণিজ্যপ্রধান বন আইন বা পুঁজিস্বার্থ সংরক্ষণকারী আইন পরিবর্তন জরুরি। এই আইনকে যুগোপযোগী করতে একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। দুঃখজনক হচ্ছে, এটি অনেকাংশে পুরোনো আইনের অনুবাদ।

খাল–বিল, নদ-নদী, সাগরের কর্তৃত্ববাদী দখল ও লুণ্ঠন এড়াতে নতুন আইন প্রয়োজন। একইভাবে স্থানীয় লোকজ জ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের সমন্বয় করে নদী ও জলাভূমির সংরক্ষণ দরকার। সবুজ উৎপাদনব্যবস্থা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।

সঠিক পরিকল্পনার জন্য বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যানের বড় প্রয়োজন। দরকার জনগণের কাছে জবাবদিহির। আইন ক্ষমতাশীলদের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে না।

মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে আন্তসম্পর্ক, পরস্পর নির্ভরশীলতা, সহযোগিতা ফিরিয়ে আনা গেলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং মানুষ ও পরিবেশ উভয়েই ভালো থাকবে। মানুষ যেমন প্রকৃতি ধ্বংসে দায়ী, তেমনি মানুষের চেষ্টাতেই প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেতে পারে। বিপন্ন প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেলে রূপসী বাংলায় পরিতৃপ্ত হবে জীবন।

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, চেয়ারম্যান, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়