একুশের স্মৃতি—২

রক্তাক্ত রাজপথ

শিক্ষার্থীদের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন জনতার স্রোতোধারায় মিশে সফল হয়েছিল বায়ান্নর একুশে। সেই প্রতিবাদী দিনের অমলিন স্মৃতিকথা।

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক

একুশে ফেব্রুয়ারির বিস্ফোরক মুহূর্তটির প্রকাশ ঘটেছিল ওই দিন দুপুর পেরিয়ে বেলা তিনটার কিছুক্ষণ পর। অবশ্য সকাল থেকেই দিনটি ছিল ঘটনাবহুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আর্টস বিল্ডিং’-এর প্রাঙ্গণে ছাত্রজমায়েত, আমতলার ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত, দশজনি মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙার মুখে পুলিশের লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার, কাঁদানে গ্যাস বর্ষণ—তখন ছাত্রদের লক্ষ্য একটাই, কোনোমতে পরিষদ ভবনের লাগোয়া মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে পৌঁছানো। মুখে মুখে স্লোগান—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’, ‘চলো চলো অ্যাসেম্বলি চলো’।

শুধু ছাত্রদের কণ্ঠে স্লোগানই নয়, পরিষদ ভবনের কাছাকাছি ২০ নম্বর ব্যারাকের ১ নম্বর কক্ষে মেডিকেল ছাত্রদের স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের মাইকে দুপুর থেকেই চলেছে স্লোগান আর অবিরাম প্রচার, প্রচার রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে উপস্থিত-অনুপস্থিত পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে। এর মধ্যে তরুণ ছাত্রদের কয়েকজন রাস্তা থেকে মানিকগঞ্জের এমএলএ আওলাদ হোসেনকে হোস্টেলে নিয়ে আসে। ঘিয়ে রঙের শেরোয়ানি পরা, মাথায় টুপি, মুখে মেহেদিরঞ্জিত পাকা দাড়ি, প্রবীণ এমএলএ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পরিষদে প্রস্তাব তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবেই ছাড়া পান। মন্ত্রী হাসান আলী অবশ্য হোস্টেলে আসতে রাজি হননি। রাজি হননি বাকি সাহেবও। পুলিশি পাহারায় তাঁরা চলে যান পরিষদ ভবনের দিকে, মন্ত্রী মহোদয়ের গাড়ির দায়িত্ব নেয় পুলিশ। অবশ্য কংগ্রেসদলীয় পরিষদ সদস্যদের দু-একজন ছাত্রদের আশ্বস্ত করেন এই বলে যে তাঁরা পরিষদে বাংলার পক্ষে প্রস্তাব রাখবেন।

ছাত্রদের পরিষদ ভবনে পৌঁছানোর চেষ্টা এবং পুলিশের ধাওয়া—এমনই এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পুলিশ সমবেত ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রথমে রাস্তায় কলেজ গেটের উল্টো দিকে উপস্থিত ছাত্রদের লক্ষ্য করে। সেখানে একজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর পুলিশ হোস্টেল গেটের কিছুটা ভেতরে ঢুকে সমবেত ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। ছাত্ররা ছুটে হোস্টেল ব্যারাক ও এক পাশে দাঁড়ানো আমগাছের আড়ালে আশ্রয় নেন। কিন্তু কয়েকজন সহকর্মীকে পড়ে যেতে দেখে প্রধানত মেডিকেলের ছাত্ররাই এসে সেদিকে ছুটে যান।

গেটের কাছে রাস্তার গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ১২ নম্বর ব্যারাকের সামনে গুলিবিদ্ধ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত। তাঁর ঊরুতে গুলি লাগে। তাঁকে বহন করে হাসপাতালে নিয়ে যান শামসুল বারী (মিয়া মোহন) ও কয়েকজন মেডিকেলের ছাত্র। ১৪ নম্বর ব্যারাকের সামনে মাথায় গুলি লেগে পড়ে যান মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র রফিকউদ্দিন। মগজ ছিটকে পড়ে প্রাঙ্গণের ধুলায়-ঘাসে। তাঁকে স্ট্রেচারে করে সরিয়ে নেন কয়েকজন মেডিকেলের ছাত্র। আর ২০ নম্বর ব্যারাকের সামনে তলপেটে গুলিবিদ্ধ হন গফরগাঁওয়ের কৃষক-যুবা আবদুল জব্বার। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান ২০ ও ১৮ নম্বর ব্যারাকের বাসিন্দা দুই সহপাঠী। তাঁদের সঙ্গে কিছুদূর পর্যন্ত আমিও হাত লাগাই। আহত ব্যক্তিদের উপস্থিত অনেকে মিলে হাসপাতালে নিয়ে যান।

সূত্র: বিস্ফোরক একুশে থেকে স্মৃতির মিনার, আহমদ রফিক; একুশের পটভূমি একুশের স্মৃতি, সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন।

আহমদ রফিক: ভাষাসংগ্রামী, লেখক, গবেষক