টিআইবির সংবাদ সম্মেলন

সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি পাস হলে তা হবে ‘কালো আইন’

সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান
ছবি: প্রথম আলো

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খোলস পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি করা হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মৌলিক দুর্বলতা ও উদ্বেগের কারণগুলো রয়েই গেছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, সেটি যদি আইনে প্রণীত হয়, তাহলে এটিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো ‘কালো আইন’ হিসেবে প্রণীত হবে। তখন এটিও মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। তাই অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে খসড়াটিতে ঢেলে সাজাতে হবে।

আজ বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। ‘খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইন–২০২৩: পর্যালোচনা ও সুপারিশ’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের তুলনামূলক তথ্য উপস্থাপন করেন টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম।

নতুন করে দুটি ধারাকে জামিনযোগ্য করে গত সোমবার ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন–২০২৩’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে এখন প্রস্তাবিত আইনে জামিনযোগ্য ধারাগুলো হলো ১৮ (১) (খ), ২০, ২১,২২, ২৩,২৪, ২৫,২৬, ২৮,২৯, ৩০,৩১, ৩২ ও ৪৬। এর আগে মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দেওয়ার সময়ে (৭ আগস্ট) আইনের খসড়ায় অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ছয়টি। এখন দুটি ধারা (২১ ও ৩০) নতুন করে জামিনযোগ্য করায় অজামিনযোগ্য ধারা রয়েছে চারটি। যদিও সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকের আশঙ্কা, প্রস্তাবিত আইনে সাজা কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো ইতিবাচক হলেও বিভিন্ন অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট না করা এবং  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক বিষয়বস্তু প্রায় একইভাবে রেখে দেওয়ার কারণে প্রস্তাবিত আইনেও মানুষকে হয়রানি করার সুযোগ থেকেই যাবে। অবশ্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে অংশীজনদের ডেকে আলোচনা করা হবে।

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে আলোচনার মধ্যেই আজ সংবাদ সম্মেলনে আইনের খসড়াটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে টিআইবি।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি প্রক্রিয়া ও বিষয়বস্তু—উভয় বিবেচনায় বিতর্কিত। প্রক্রিয়াগত বিতর্কের কারণ হলো, এই সরকারের সময় একটি ইতিবাচক চর্চা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত করা। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। শুধু মতামতের জন্য ১৪ দিন সময় দিয়ে খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁরা ধরে নিতে চান সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে সম্পৃক্ত করার এখনো সুযোগ আছে এবং সরকার এটি নিশ্চিত করবে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি যেভাবে প্রণীত হয়েছে, তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ কমানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়ানোও হয়েছে। তা সত্ত্বেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মৌলিক দুর্বলতাগুলো এখানেও রয়ে গেছে। যেসব কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্বেগ ছিল, সেগুলোও রয়ে গেছে। মানুষের মৌলিক অধিকার, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বাক্‌স্বাধীনতা, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা বিশেষ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা—এ বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, সেগুলোর চেতনা ও বিষয়বস্তু দুটিই সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াতেও আছে। শাস্তি কমানোয় সাধুবাদ। কিন্তু মূল বিষয় হলো এটি (বর্তমান খসড়াটি) নিবর্তনমূলক।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ‘কালো আইন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, সেটিই যদি আইনে প্রণীত হয়, তাহলে এটিও ‘কালো আইন’ হিসেবে প্রণীত হবে। তখন এটিও মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা খর্ব করার মতো ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মত প্রকাশ করলে, তথ্য প্রকাশ করলে, চিন্তা ও বিবেক প্রকাশ করলে ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার বার্তাটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই আইনের উদ্দেশ্য যদি হয়, সাইবার নিরাপত্তা তাহলে তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। খসড়াটি এখন যে অবস্থায় আছে, সেটি যদি অনুমোদিত হয় তাহলে সেটিকেও ‘নিবর্তনমূলক আইন’ বলা ছাড়া উপায় থাকবে না। এটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিছুটা পরিবর্তন করে, কিছু শাস্তি বাড়ানো-কমানোর নামে শুধু খোলস পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়বস্তু অপরিবর্তিত রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের যেটি উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল, সেই সাইবার সিস্টেমকে নিরাপত্তা না করে সাইবার সিস্টেম ব্যবহার করে মতপ্রকাশ, তথ্যপ্রকাশ, চিন্তার প্রকাশের জায়গায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট অংশীজন, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাইবার নিরাপত্তার যে চর্চা, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি ঢেলে সাজাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে মূল উদ্দেশ্য, সেখানে মতপ্রকাশ ও বাক্‌স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে—এ রকম বিষয়বস্তু থাকার কথা নয়। যদি মতপ্রকাশের নামে বা তথ্যপ্রকাশের নামে অন্য কারও অধিকার হরণ বা মানহানি হয়, সে জন্য প্রচলিত আইন আছে। প্রচলিত আইনেই তার বিচার হবে। এখানে সাইবার নিরাপত্তা আইনে তার বিচার নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো যুক্তি আছে বলে তিনি মনে করেন না।

সংবাদ সম্মেলনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের তুলনামূলক তথ্য উপস্থাপন করতে গিয়ে টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম বলেন, সাইবার অপরাধ একটি ভিন্নধর্মী অপরাধ, সাইবার নিরাপত্তা ভিন্ন ধরনের কাঠামো; যেখানে কম্পিউটার ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ইত্যাদির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা। এর বাইরে যত অপরাধ আছে, সেগুলো প্রচলিত আইনে বিচার করা সম্ভব। এগুলো সাইবার নিরাপত্তার অংশ হতে পারে না।

শেখ মনজুর-ই-আলম বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে যে খসড়াটি হয়েছে, সেটি মূলত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম পরিবর্তন করে করা হয়েছে। এ ছাড়া যে পরিবর্তন, সেটি হলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারাদণ্ড বাদ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে।

শেখ মনজুর-ই-আলম আরও বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াতেও পুলিশকে ‘ঢালাও ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে। এখানে পুলিশ কর্মকর্তার ‘মনে করার ওপর’ নির্ভর করতে হচ্ছে। কারণ, পুলিশ কর্মকর্তা যদি মনে করেন, প্রস্তাবিত আইনের অধীনে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তাহলে তিনি বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি করতে পারবেন এবং প্রয়োজনে গ্রেপ্তারও করতে পারবেন। এটি ভয়ংকর আশঙ্কা তৈরি করছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) সুমাইয়া খায়ের ও কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম।