‘হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ, তারপর সবকিছু অন্ধকার’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আছেন নওশাদ সেলিম চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো

সত্তরোর্ধ্ব নওশাদ সেলিম চৌধুরী প্রায় ২২ বছর ধরে সীমা অক্সিজেন লিমিটেড নামে প্ল্যান্টটির হিসাব সামলাচ্ছেন। জীবনের অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আসা এই বৃদ্ধ কাজ ছাড়া থাকতে পারেন না। তাই ওখানে গিয়ে সময় দেন। এত বছরের চাকরিজীবনে কখনো এমন পরিস্থিতি তিনি দেখেননি। সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর এই বৃদ্ধ যেন এখন দ্বিতীয় জীবন পেয়েছেন।

অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের পর নওশাদ সেলিম চৌধুরীও আহত হন। তাঁর ঠাঁই হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে। তাঁর মাথায় কাচ ও লোহার টুকরা লেগে ক্ষত হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আঘাত গুরুতর নয়। শুধু ডায়াবেটিসটা নিয়ন্ত্রণে এলে তিনি বাড়ি ফিরতে পারবেন।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আজ রোববার সকালে ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা দিলেন নওশাদ সেলিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্ল্যান্টের পাশে একটি অফিস কক্ষ আছে। সেখানে বসে কাজ করছিলাম। এর কিছুক্ষণ আগে সেখান থেকে বের হয়ে গেছেন পরিচালক আনোয়ার সাহেব। আমিও ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখনই হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। হতবিহ্বল হয়ে পড়ি।’

বিস্ফোরণের পর চারদিকে কেবল চিৎকার–চেঁচামেচি। একপর্যায়ে বের হয়ে পড়েন নওশাদ সেলিম। তখন তিনি মাথায় যন্ত্রণা অনুভব করেন। তাঁর মাথা বিভিন্ন স্থানে কেটে যায়। কাচ আর লোহার টুকরা এসে লাগে।

সীমা অক্সিজেন লিমিটেডে প্ল্যান্টে উৎপাদন সেকশনে কাজ করতেন মো. মোতালেব। তিনি কোমর ও মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছেন

নওশাদ সেলিম বলেন, ‘কীভাবে যে আমি ওখান থেকে বের হয়েছি, তা নিজেও জানি না। বের হতে দেখি সবকিছু দুমড়েমুচড়ে গেছে। আগুন জ্বলছে। পরে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এত বছর চাকরি করছি, কিন্তু এমন ঘটনা আর দেখিনি।’

ঘটনার সময় ভেতরে–বাইরে শ্রমিক ও পরিবহনশ্রমিক মিলে ২৫ থেকে ৩০ জন ছিলেন বলে নওশাদ সেলিম জানান।

মো. মোতালেব (৪৫) কাজ করতেন ওই প্ল্যান্টের উৎপাদন সেকশনে। তিনি কোমর ও মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছেন। মাথায় ছয়টি সেলাই পড়েছে। তাঁর বাড়িও ভাটিয়ারীতে। নিউরোসার্জারি বিভাগে তাঁর চিকিৎসা চলছে।

মোতালেব বলেন, ‘তীব্র শব্দে সবকিছু কেঁপে ওঠে। তখন ভেতর ১০ জন কাজ করছিলাম। আমি কোনোরকমে বের হয়ে আসি। এরপর দেখি আগুন জ্বলছে। আর আমার মাথায় হাত দিয়ে দেখি রক্ত ঝরছে। আর কার কী হয়েছে জানি না। ওখান থেকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।’

মোতালেব ২৪ বছর ধরে কাজ করছেন এই কারখানায়। হাসপাতালে তাঁর শয্যা পাশে রয়েছেন স্ত্রী রেজিয়া বেগম। স্ত্রী বলেন, ‘আমার দুটি মেয়ে। স্বামীর এই অবস্থায় আমি কীভাবে চলব জানি না। কত দিনে সুস্থ হয়, তা–ও বলতে পারছি না।’

চমেক হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে রয়েছেন প্ল্যান্টের নিরাপত্তা প্রহরী মজিবুর রহমান

মোতালেবের পাশের শয্যায় রয়েছেন প্ল্যান্টের নিরাপত্তা প্রহরী মজিবুর রহমান (৫০)। তাঁর ডান হাত ভেঙে গেছে। মাথা ও ডান পায়ে আঘাত রয়েছে। মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত। নিরাপত্তা প্রহরী মজিবুর তখন সিলিন্ডার গুনছিলেন।

মজিবুর বলেন, ‘ঘটনার আগে আমি একটি ট্রাকে লোড করার সময় বোতল গুনছিলাম। এমন সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। একপর্যায়ে আমি ঘুরে পড়ে যাই। কিসের আঘাত লেগেছে, তা–ও জানি না। যখন চোখ মেলি, তখন দেখি আমি গাড়িতে।’

নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহফুজুল কাদের বলেন, এই তিন রোগীর মধ্যে বৃদ্ধের অবস্থা এখন ভালো আছে। বাকি দুজনের নানা আঘাত রয়েছে। চিকিৎসা চলছে। তবে তাঁদের জ্ঞানের (সেন্স) মাত্রা ভালো আছে।