ভারত থেকে আমদানির অনুমতি দেওয়ার খবরে দেশের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম দ্রুত কমছে। ঢাকার শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে আজ সোমবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশি পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দর ২০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় গতকাল রোববার জানায়, আজ থেকে পেঁয়াজ আমদানি অনুমতি দেওয়া শুরু করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখা। এরপরই পাইকারি বাজারে দাম কমতে শুরু করে।
ভারতীয় পেঁয়াজ এলে দাম আরও অনেকটা কমে যাবে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, ভারতে পেঁয়াজের দাম অনেক কম।
পুরান ঢাকার মসলাজাতীয় পণ্যের পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র শ্যামবাজারের নবীন ট্রেডার্সের মালিক নারায়ণ চন্দ্র সাহা আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, আগের দিন যে পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৮৫ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হয়েছে, সেটা কমতে কমতে নেমেছে ৬৫ টাকায়।
শ্যামবাজারে পেঁয়াজের দামে সাধারণত দ্রুত ওঠানামা হয়। অন্য বাজারে প্রভাব পড়ে একটু দেরিতে। কারওয়ান বাজারের আড়তে ঘুরে আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দেখা যায়, কোনো কোনো দোকানে ৫ কেজি কেনার ক্ষেত্রে কেজিপ্রতি দর ৯২ টাকা, কোথাও ৮৬ টাকা, কোথাও ৮২ টাকা এবং কোথাও ৮০ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা।
দামের এত হেরফের কেন, তা জানতে চাইলে একজন বিক্রেতা বলেন, বাজার যখন অস্থির হয়, তখন এই অবস্থা হয়। ভারত থেকে পেঁয়াজ আসবে বলে কেউ কেউ কম দামে ছেড়ে দিচ্ছেন।
কারওয়ান বাজার ঘুরে দেশি পেঁয়াজই দেখা গেল। বাছাই করা দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করছিলেন সম্পদ আলী নামের এক বিক্রেতা। তিনি বলেন, সকালে দাম কেজিপ্রতি ৬ টাকা কমেছে। ভারতের পেঁয়াজ নাকি আসছে। এই খবরে বাজার পড়তি।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে আজ পাইকারিতে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয় মানভেদে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। আগের দিন তা ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এফ এম ট্রেডার্সের কর্ণধার মো. মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আমদানির অনুমতির ঘোষণা আসার পর দাম অনেক পড়ে গেছে। কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই। দাম আরও কমবে, এ আশায় কেউ পেঁয়াজ কিনছেন না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে উৎপাদন ভালো হলে মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। বাকি ৩০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। উৎপাদনের পরিমাণ ৩৫ লাখ টন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, পেঁয়াজের উৎপাদন আরও কম। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৫ লাখ টনের কিছু বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে।
ওদিকে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, চাহিদা ২৫ লাখ টনের মতো। কমিশন এ–ও বলে থাকে, উৎপাদনের ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ সংরক্ষণ ও পরিবহনকালে নষ্ট হয়।
পেঁয়াজ আমদানি করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখা থেকে আমদানির অনুমতি বা আইপি নিতে হয়। কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করে গত ১৫ মার্চ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছিল মন্ত্রণালয়। অবশ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানিতে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি।
কৃষি মন্ত্রণালয় আমদানিতে অশুল্ক বাধা তৈরি করে রাখার কারণে এক মাসে দেশে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। ঢাকার খুচরা বাজারে গতকাল পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়, যা এক মাস আগে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা ছিল।
ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদন বলছে, ভারতে গত ৩০ মে পাইকারিতে পেঁয়াজের টনপ্রতি দর ছিল ১২১ ডলার। এতে কেজিপ্রতি দর পড়ে ১৩ টাকা। পেঁয়াজে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে ‘পড়তা’ (খরচসহ দাম) পড়তে পারে কেজিপ্রতি ২০ টাকার আশপাশে। এরপর যে দামে বিক্রি হবে, সেটাই মুনাফা।
শ্যামবাজারের নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, বাজারে যদি ৪০ টাকা কেজি দরেও ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি করা যায়, তাহলেও আমদানিকারকেরা ভালো লাভ করতে পারবেন।
কৃষকেরা সাধারণত ঘরের মাচায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেন। সেই পেঁয়াজ মাসে মাসে বিক্রি করে পরিবারের ব্যয় মেটান। আবার মৌসুমের শেষ দিকে পেঁয়াজ বিক্রি করে পরবর্তী মৌসুমের কৃষি উপকরণ কেনা হয়।
আড়তমালিক ও কৃষকেরা বলছেন, এ কারণে বাজারে দাম ১০০ টাকা উঠলেও সব কৃষক পেঁয়াজ বিক্রি করে দেননি। কিন্তু ভারতীয় পেঁয়াজের কারণে দাম যদি একেবারেই কমে যায়, তাহলে পরের মৌসুমে আবাদে উৎসাহ থাকবে না।
পাবনার সুজানগর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের কৃষক তৌফিক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল পেঁয়াজের মণপ্রতি দর ছিল ৩ হাজার ২০০ টাকা (কেজিপ্রতি ৮০ টাকা), যা আজ ২ হাজার ৬০০ টাকায় (কেজিপ্রতি ৬৫ টাকা) নেমেছে।
কোনো দেশ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে দুভাবে। শুল্ক আরোপ করে অথবা অশুল্ক বাধা তৈরি করে। বাণিজ্যনীতিতে আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধও রাখা যায়।
বাণিজ্য–বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কৃষককে সুরক্ষা দিতে এমনভাবে পেঁয়াজ আমদানির শুল্কহার ঠিক করতে হবে, যাতে আমদানিমূল্য দেশে উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেকটা বেশি হয়। এতে আমদানিও হবে, আবার দামও কমে যাবে না।
ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, মৌসুমের সময় পেঁয়াজ আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশি হারে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা এবং দাম বাড়লে তা কমিয়ে দেওয়ার নীতি নেওয়া যেতে পারে। কারণ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের জন্য সরকারকে সংসদে যেতে হয় না। তিনি বলেন, পেঁয়াজ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। এটার আমদানি পুরো বন্ধ রাখার কৌশলটি ঠিক নয়।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও প্রতিনিধি, পাবনা]