গাছের ছায়ায়, প্রকৃতির মায়ায় রুশদী বিশ্বাসের আধা পাকা বাড়ি। রোদ–ঝলমল হালকা বাতাসে নড়ছে বাঁশগাছের পাতা। ঘড়ির কাঁটায় বেলা আড়াইটা। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে এক-দুজন করে নারী আসতে শুরু করেন। উঠানে তাঁদের জন্য আয়োজিত নির্দিষ্ট স্থানে বসেন সবাই।
ইন্টারনেট যে মানুষের নানাবিধ চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, বিষয়টি সরাসরি শেখাতে গ্রামীণফোনের উদ্যোগে দেশজুড়ে চলছে উঠান বৈঠক। ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ উদ্যোগটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি।
গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেটবিষয়ক জ্ঞান বাড়াতে দুই হাজার ইউনিয়নে আয়োজিত হচ্ছে উঠান বৈঠক। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে শুরু হয় এ আয়োজন। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৭ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার খট্টা ইউনিয়নের মাধবপাড়া গ্রামের রুশদী বিশ্বাসের বাড়ির উঠানে অনুষ্ঠিত হয় উঠান বৈঠক।
শুভেচ্ছাপর্ব শেষে অংশগ্রহণকারী নারীদের ‘শাপলা’ ও ‘দোয়েল’ নামের দুটি দলে ভাগ করা হয়। গ্রামীণ নারীরা সাধারণত এ ধরনের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে অভ্যস্ত নন। তাই শুরুতেই ‘পাখি ওড়ে’সহ বিভিন্ন পরিচিত খেলার মাধ্যমে তাঁদের জড়তা ভাঙানোর চেষ্টা করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে শুরু হয় বিভিন্ন পর্ব।
সঞ্চালক জানতে চান, মোবাইল ইন্টারনেট তাঁরা কী কী কাজে ব্যবহার করেন। উত্তর আসে, কেউ বিদেশে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন, কেউ ইউটিউবে ভিডিও দেখেন, কেউবা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবসর সময় কাটান। অনেকেই বলেন, ফেসবুক বা ইউটিউব ঘাটতে ঘাটতে যে ভিডিও সামনে আসে, সেটিই দেখেন। কিন্তু ইউটিউব দেখেও যে অনেক কিছু শেখা যায়, তথ্যটি জেনে উপস্থিত নারীদের অনেকেই অবাক হন। এরপর ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে তাঁদের দেখানো হয়, ‘সার্চ অপশন’ ব্যবহার করে কীভাবে প্রয়োজনীয় বা পছন্দের ভিডিও বা খবর খুঁজে বের করা যায়। পাশাপাশি যাঁরা টাইপ করতে পারেন না, তাঁরা ভয়েস কমান্ড দিয়ে কীভাবে কাঙ্ক্ষিত কনটেন্টটি দেখতে পারবেন, সে বিষয়েও শেখানো হয়।
সাধারণত পরিবারের সদস্যসহ সাংসারিক অনেক কিছুরই খেয়াল রাখার ফলে গ্রামীণ নারীরা সাধারণ নিজেদের যত্নের প্রতি উদাসীন থাকেন। তাই উঠান বৈঠকে নারীদের রক্তশূন্যতা, এর লক্ষণ এবং এটি প্রতিরোধে কোন ধরনের খাবার খেতে হবে, সে বিষয়ে স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক একটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। এরপর দেখানো হয় শিশুদের বিকাশ, যত্ন ও পুষ্টিবিষয়ক আরেকটি ভিডিও। গ্রামে থেকেও ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন, এমন সফল কয়েকজন নারী উদ্যোক্তার গল্পও দেখানো হয় উঠান বৈঠকে।
প্রতিটি পর্ব শেষে উঠান বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আয়োজন করা হয় কুইজ প্রতিযোগিতা। বিজয়ীদের দেওয়া হয়েছে ঢাকা ব্যাংকের সৌজন্যে আকর্ষণীয় পুরস্কার। সুযোগ ছিল আকর্ষণীয় মূল্যছাড়ে নকিয়ার মোবাইল হ্যান্ডসেট কেনার। এ রকমই উচ্ছ্বাস-উৎসাহ ও নানা আয়োজনে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাতোর, শিবরামপুর, শতগ্রাম, মোহনপুর, পাল্টাপুর, নিজপাড়াসহ দিনাজপুর জেলার ৪৮টি ইউনিয়নে। সেসব বৈঠকের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করতে সাহস ও উৎসাহ জোগানো হচ্ছে।
তাঁদের মতোই একজন খট্টা ইউনিয়নের গৃহিণী মোসাম্মত সাজিদা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আপা যদি শুধু মুখে কথাই বলে যেতেন, তাহলে এভাবে মনে রাখতে পারতাম না। কথার সঙ্গে বড়পর্দায় ভিডিও এবং মজার মজার কুইজ খেলার কারণে প্রায় সব তথ্যই মনে রাখা সহজ হয়েছে। উঠান বৈঠকে এসে আমার খুব ভালো লাগছে।’
কুইজের সঠিক উত্তর দিতে পুরস্কার জেতেন বীরগঞ্জ উপজেলার শিবরামপুর ইউনিয়নের শম্পা রানী রায়। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এখানে আমার আসার কোনো ইচ্ছা ছিল না। অন্যদিন দুপুরে আমি ঘুমাই। কিন্তু আজ আশপাশের বাড়ির আপা আর ভাবিদের দেখে আমি চলে আসছি। অনেক কিছু শিখলাম। ভাবি নাই যে পুরস্কারও জিতব।’
সঠিকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য জানতে হয় কীভাবে মোবাইলে ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনা যায়। তাই উঠান বৈঠকে উপস্থিত নারীদের নির্দিষ্ট কোড ডায়াল করে পছন্দের ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার নিয়মও দেখানো হয়। পাশাপাশি তাঁদের সচেতন করা হয় নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়েও। ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা যাতে জীবনে চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারেন, সেই লক্ষ্যেই আয়োজন করা হচ্ছে উঠান বৈঠক।
উল্লেখ্য, বিশেষ এই কার্যক্রম আজ বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিভাগের ৯৮৯টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে।