ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েটি কত দিন সংগ্রাম চালাতে পারবেন, নিশ্চিত নই

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন। সাড়ে চার ঘণ্টা নির্যাতনের পর ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় বলেও জানান ফুলপরী। তিনি এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেত্রীদের নামসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন। এ ঘটনায় রিট হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের পাশাপাশি কিছু নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।

ফুলপরীর প্রতিবাদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান
প্রশ্ন

প্রথম আলো: ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেত্রীদের বিরুদ্ধে ফুলপরী খাতুনের প্রতিবাদ করার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ সাহসী হতে বাধ্য হয়। পরে কী হবে, সেটা চিন্তা করে না। এই শিক্ষার্থীও তা–ই করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যাঁরা সাহস করে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনাকে সামনে এনেছেন, তাঁরা অন্য রকম সংকটের মধ্যেও পড়েছেন। সামাজিক সংকট তো আছেই। প্রতিবাদ করার পর নিপীড়নের ধরনটা পাল্টে যায়। বিভিন্ন রকম সরকারি, রাষ্ট্রীয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও চাপ সইতে হয়। শুধু ভুক্তভোগী নয়, তাঁর পরিবারকেও এ চাপ সইতে হয়। এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়, যাতে পরবর্তী সময়ে আর কেউ প্রতিবাদ করার সাহস না পান। তাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েটি আরও নিরাপত্তাহীন হলেন কি না, বা তিনি তাঁর সংগ্রাম কত দিন চালিয়ে যেতে পারবেন, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের মাধ্যমে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা তো নতুন কিছু নয়...

অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনাগুলো স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ঘটছে। এর পেছনের কারণ হলো, শিক্ষকের কাজ শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাই থাকে, শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। মুশকিল হলো, এখন তো আর আমরা শিক্ষক নই। ক্ষমতাসীন দল যাঁরা করেন, তাঁরাই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোয় থাকেন। প্রশাসনিক পদে থেকে শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা, শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করার চেয়ে সরকারকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়, যার ফলে সরকারি সংগঠনের কর্মী আর প্রশাসনিক শিক্ষকের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর জন্য প্রশাসনিক কাঠামো প্রযোজ্য হয় না। আবাসিক হলগুলোয় নেতৃত্বে থাকা ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা হলের প্রভোস্ট বা হাউস টিউটরকেও মনে করেন তাঁদের মতো ক্ষমতাসীন দলের কর্মী। ফলে শিক্ষক–শিক্ষার্থীর মধ্যে স্বাভাবিক যে সম্পর্ক থাকার কথা, তা থাকছে না। এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে যে ধরনের শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থা থাকা উচিত, তা অনুপস্থিত থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এক দশক ধরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তর্কোন্দল চলছিল। এই কোন্দলের শিকার হয়েছেন অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী। এর পেছনের কারণ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...

অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন যতই অপরাধ করুক, শাস্তি হয় না। কখনো ব্যক্তিবিশেষে শাস্তি হয়। তবে প্রভাবশালী নেতারা শাস্তি পান না। শাস্তি পান মাঠপর্যায়ের কর্মীরা। এসব কর্মীকে যারা অপরাধী বানাল, যাদের নেতৃত্বে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের অপরাধী বানানোর প্রক্রিয়া জারি থাকে, ওই নেতারা শাস্তির আওতার বাইরে থেকে যান। এসব নেতাই অপরাধের ঘটনা প্রকাশ পেলে উল্টো সুরে কথা বলেন। আর উল্টো সুরে কথা বলেন যাঁরা, তাঁরাই অপরাধী বানানোর প্রক্রিয়াটা জারি রাখেন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপদ থাকা বা এ ধরনের নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় নেই?

অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: এ ধরনের নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়। যেসব শিক্ষক প্রশাসনিক দায়িত্বে আছি, তারা যদি সত্যিকার শিক্ষকের মতো দায়িত্ব পালন করি, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বা সেবকের মতো আচরণ না করি, তাহলেই সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু মুশকিল হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনের দায়িত্বে সরকার এমন সব মানুষকেই নিয়ে আসেন, যাঁরা ক্ষমতাসীন দলের সেবক হবেন। ফলে তখন বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় কারা, কার ছত্রচ্ছায়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছেন, তা প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা জানেন। তা প্রকাশ্যে স্বীকার করুন আর না–ই করুন। তারপরও কেউ যদি বলেন, তিনি অপরাধীদের জানেন না, আমি বলব, এটি সত্যকে লুকানো ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: হাইকোর্টের আদেশের পর ফুলপরী খাতুনকে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা দেওয়া ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছিলাম।

অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: সাধারণ শিক্ষার্থীর কিছু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের করার কিছু থাকবে না কেন? প্রশাসনিক দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিক নন? এ ছাড়া অনেক উদাহরণ তো আছে, যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেক মামলা করে। তাই নির্যাতনের বা অপরাধের ঘটনা ঘটলে কেন মামলা করতে পারবে না? এ ক্ষেত্রে যদি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে অপরাধীরা জড়িত না থাকতেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিকই ব্যবস্থা নিত। তাই এই শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে নিরাপদে থাকতে পারবেন, সে আস্থার পরিবেশ তো তৈরি করা যাচ্ছে না।