‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই সম্ভব’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথা বলেন বিআরবি হাসপাতাল লিমিটেডের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের চিফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন
‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই সম্ভব’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথা বলেন বিআরবি হাসপাতাল লিমিটেডের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের চিফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন

ক্যানসার জয় করতে দরকার প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি ধরতে পারা

‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২০২২ সালে প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে এক লাখের মৃত্যু হয়। আর বিশ্বে প্রতিবছর ক্যানসারে প্রায় দুই কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে মৃতের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। বর্তমানে প্রোস্টেট ক্যানসারের ব্যাপকতা বেড়েছে। বিশ্বে প্রতিবছর আটজনের মধ্যে একজন পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসার হয়।’ এমনই সমীক্ষা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন।

সেপ্টেম্বর মাস, প্রোস্টেট ক্যানসার সচেতনতার বিশেষ মাস। এ উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলজি আয়োজিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই সম্ভব’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। অনুষ্ঠানে ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, প্রতিরোধে করণীয় ও দেশের চিকিৎসা–সুবিধা নিয়ে আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানটি গতকাল মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে। এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন বিআরবি হাসপাতাল লিমিটেডের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের চিফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন।

উপস্থাপক প্রথমেই জানতে চান, বাংলাদেশে কোন ক্যানসারের হার সবচেয়ে বেশি? সেখানে প্রোস্টেট ক্যানসারের অবস্থান কততম?

ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় খাদ্যনালির ক্যানসারে। এরপর ক্রমানুসারে রয়েছে মুখগহ্বর ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার, সারভাইকেল ক্যানসার ও প্রোস্টেট ক্যানসার।’

প্রোস্টেট ও স্তন লিঙ্গভিত্তিক ক্যানসার। এমন রোগের ঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ডোন্ট বার্গেইন উইথ ইয়োর প্রোস্টেট—প্রোস্টেটের সঙ্গে কোনো দরাদরি নেই। ফুসফুস বা লাং ক্যানসারের তুলনায়ও এর মৃত্যুর হার কম। সুতরাং এটি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।’

প্রোস্টেট ও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিতে কারা এবং কেন এটি হয়—এই প্রশ্নের জবাবে ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকিতে থাকে প্রথমত পুরুষ, যাঁদের বয়স পঞ্চাশের বেশি। স্বাভাবিকভাবে ৭০ থেকে ৮০ বছরের পুরুষেরা আক্রান্ত হন। অর্থাৎ ৩৫ থেকে ৪০–এর আগে সাধারণত হয় না। এটি মেইল সেক্স হরমোনের ওপর নির্ভর করে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যভ্যাসের কারণে এ রোগের ঝুঁকি বাড়ে। যেমন সবজি কম, ফ্যাট বেশি খাওয়া। তাই ফল, সবজি, মাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। টমেটো প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। এ ছাড়া সূর্যরশ্মি ও রেডিয়েশন প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান ও মদ্যপানের কারণেও এটি হতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বংশগতভাবেও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আর স্তন ক্যানসার হয় ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ নারীদের, যাঁদের বয়স ৪০–এর বেশি। এটি ফিমেইল হরমোনের ওপর নির্ভর করে। ঋতুস্রাব বেশি দিন পর্যন্ত হওয়া, সন্তান না নেওয়া, শিশুকে স্তন্যপান না করানো এবং বংশগত—এসব কারণে নারীদের স্তন ক্যানসার হয়ে থাকে।

প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণগুলো সম্পর্কে উপস্থাপক জানতে চাইলে ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘অনেকেই প্রোস্টেট ক্যানসার ও বিনাইন হাইপার ট্রপি অব প্রস্ট এনলার্জমেন্ট অব প্রোস্টেট (বিইপি)—এ দুয়ের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। কারণ, দুটি রোগের লক্ষণ প্রায় একই। সেগুলো হলো, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাব আটকে রাখতে না পারা, প্রস্রাব আটকে যাওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রায়ই ইউরিন অ্যাটাক ইনফেকশন হওয়া এবং যৌনক্ষমতা হ্রাস পাওয়া।’

এ সংশয় দূর করার উপায় সম্পর্কে ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, সাধারণত প্রোস্টেট ক্যানসার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে শনাক্ত হয়। যখন সেটা ছড়িয়ে পড়ে মেরুদণ্ডের হাড়ে চলে যায়। ফলে কোমরে ব্যথা হয়। এটা প্রোস্টেট ক্যানসারেরই লক্ষণ। তাই সংশয় দূর করতে প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডটাকে মূল্যায়ন ও পিএসএ টেস্ট করতে হবে।

এরপর উপস্থাপক বলেন, এ রকম পরিস্থিতিতে রোগী কখন চিকিৎসকের কাছে যাবে এবং পিএসএ টেস্টটা সম্পর্কে যদি আরেকটু বলতেন।

ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, লক্ষণ বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তো বটেই এমনকি পরিণত বয়সেও যদি কোমরে ব্যথা হয়, তাহলেও যেতে হবে। তখন চিকিৎসক ডিজিটাল রেক্টল এক্সামিনেশনের মাধ্যমে দুটি বিষয় বুঝতে পারবেন। একটি হলো, প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডটা বড় কি না; অন্যটি হলো, এটার গঠন কেমন? আর পিএসএ হলো—প্রোস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন। এটি বাড়লেই ক্যানসার হবে না। এর সঙ্গে আলট্রাসোনো, এমআরআই ও বায়োপসি করতে হয়। বায়োপসির মাধ্যমে ক্যানসারের ঝুঁকির স্তর সম্পর্কে বুঝতে পারা যায়।

ক্যানসার নিরাময়ে দেশের চিকিৎসাপদ্ধতি কতটা আধুনিক, উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, আমাদের বাংলাদেশেই বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা রয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসায় বিভিন্ন মডালিটির মধ্যে সার্জারিটাই বেশি ফলপ্রসূ। এরপর আছে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, অ্যান্টিবডি ট্রিটমেন্ট ও ইমিউনোথেরাপি। তবে অনেক ক্ষেত্রে কিছুই লাগে না, শুধু হরমোন–চিকিৎসাতেই ভালো ফল হয়।

এ পর্যায়ে উপস্থাপক জানতে চান, বাংলাদেশে বিশ্বমানের আধুনিক চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য অনেকে বিদেশে যান কেন? আর বিদেশ ও দেশের চিকিৎসার মধ্যে পার্থক্যটা কী?

এ প্রসঙ্গে ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, উন্নত ক্যানসার চিকিৎসায় আমেরিকা–সিঙ্গাপুর–ভারতের মতো আমাদেরও তত্ত্বীয় জ্ঞান আছে। চিকিৎসাব্যবস্থারও ঘাটতি নেই। ডায়াগনোসিসটা ৯৯ শতাংশ আর ইনভেস্টিগেশন ৯০ শতাংশ রয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসার মডালিটিগুলোসহ পেট সিটিস্ক্যানও আমাদের এখানে হয়। তাই আমি সবাইকে বলব, আপনারা দেশেই বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা করাতে পারেন। এর সঙ্গে যুক্ত করে উপস্থাপক জানান, বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি এবং অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট হলো ‘এসকেএফ অনকোলজি’।

‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই সম্ভব’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় গতকাল মঙ্গলবার

দেশে ক্যানসার চিকিৎসা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা ও প্রতিবন্ধকতাগুলো কী এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কী—এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, সামাজিক ভ্রান্ত ধারণা হলো, স্তন ক্যানসার হলে নারীরা পুরুষ ডাক্তারকে দেখাতে চান না। এখানে লজ্জা পাওয়া যাবে না। তারপর রয়েছে ধর্মান্ধতা, কবিরাজি চিকিৎসা এবং অশিক্ষা–অসচেতনতা। এসব থেকে উত্তরণ পেলে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত করতে পারলে ক্যানসারকে জয় করা সম্ভব হবে। আর রোগীদের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো হলো, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অনেকেরই স্বাস্থ্যবিমা নেই। এটি থাকলেও চিকিৎসা–ব্যয় বহনে কিছুটা চিন্তামুক্ত হওয়া যায়।

কেমোথেরাপি চলাকালে রোগীর করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘কোনো কিছুই নিষেধ নেই। তবে শারীরিক ফিটনেসভেদে রোগীদের কিছু বিষয় মেনে চলতে হয়। যেমন সিদ্ধ খাবার খেতে হবে। কাঁচা সবজি, সালাদ, ফ্রিজের ও বাইরের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। কেমোথেরাপি চলাকালে মাঝের সপ্তাহে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ, এ সময় শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে বলে সহজেই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাসায় তৈরি খাবার খাওয়া এবং আঙুর ও চিনি না খাওয়াই ভালো। সহজে হজম হয় এবং অল্পতে বেশি ক্যালোরি পাওয়া যায়, এ রকম প্রোটিনযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত।