প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে, তাই সড়কটিতে টোল নেবে সিডিএ

চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারের সড়কটি দিয়ে চলতে টোল দিতে হবে
ছবি: জুয়েল শীল

প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে দুইবার। সময় বাড়ানো হয়েছে চারবার। কিন্তু এখনো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্প সংশোধন এবং দফায় দফায় সময় নেওয়ায় বেড়ে গেছে প্রকল্পের ব্যয়। এখন প্রকল্পের এই বর্ধিত অর্থ দিতে রাজি নয় সরকার। তাই প্রকল্পের সড়ক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে টোল নেবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

প্রকল্পটির নাম ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের বহিঃসীমানা দিয়ে লুপ রোড নির্মাণসহ ঢাকা ট্রাংক রোড হতে বায়েজিদ বোস্তামী রোড পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ’। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ।

আনুষ্ঠানিকভাবে সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ না হলেও ২০১৯ সালের পর থেকে যান চলাচল শুরু হয়। এখনো সড়কটির কিছু কাজ বাকি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ।

সড়কটির কিছু কাজ এখনো বাকি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ

প্রথম উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সড়ক ব্যবহারে টোল নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। কিন্তু সংশোধিত ডিপিপিতে টোলের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। ইতিমধ্যে সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন পেয়েছে। এতে টোলের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সড়কটি ব্যবহার করতে হলে টোল দিতে হবে।

টোল নেওয়ার পেছনে দুটি কারণ বলছে সিডিএ। এক. প্রকল্পের বর্ধিত ব্যয়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দিতে অস্বীকৃতি। দুই. বর্ধিত ব্যয় মেটাতে সিডিএর তহবিলে অর্থ না থাকা।

তবে এ ধরনের সড়ক থেকে টোল আদায়কে অযৌক্তিক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, টোল নিলে যানজট নিরসনে গৃহীত এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।

এক দশকের পুরোনো প্রকল্প

প্রায় এক দশক আগে ২০১৩ সালের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রথম এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৬ সাল, দ্বিতীয় দফায় ২০১৮ সাল, তৃতীয় দফায় ২০২০ সাল ও চতুর্থ দফায় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রথম দফায় প্রকল্প সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় ১৪৮ কোটি টাকা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩২০ কোটি টাকায়।

গত বছরের অক্টোবরে প্রকল্পটি দ্বিতীয় দফায় সংশোধন করা হয়। এবার ব্যয় বাড়ে ৩৩ কোটি টাকা। ফলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫৩ কোটি টাকায়।

প্রকল্পের সবশেষ বর্ধিত ব্যয়ের এই অর্থ টোলের মাধ্যমে আদায় করবে সিডিএ।

সিডিএর দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা বলছেন, এই সড়ক থেকে টোল আদায়ে বেসরকারি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এ জন্য আগামী মাসে দরপত্র আহ্বান করা হবে।

সিডিএ গত ১৩ বছরে নগরে অন্তত ২০টি সড়কের সম্প্রসারণ-উন্নয়নকাজ করেছে। নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে বা চলছে—এ রকম নতুন সড়কের সংখ্যা ৪। এর মধ্যে কোনোটিতেই টোল নেয়নি সংস্থাটি। এমনকি সিডিএর নতুন করা তিনটি উড়ালসড়ক ও একটি ওভারপাস ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কোনো টাকা দিতে হয় না ব্যবহারকারীদের।

ব্যয় বৃদ্ধির যত কারণ

অন্তত নয়টি কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে বলে নথিপত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়। এর মধ্যে অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের বিষয়টিও রয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রায় ১৬টি পাহাড় কাটে সিডিএ। খাড়াভাবে কাটার কারণে পাহাড়ধসের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এখন ঝুঁকি এড়াতে পাহাড়গুলো আরেক দফা কাটতে চায় সংস্থাটি। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য লাগবে ১১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। মাটি ভরাটের কাজে বাড়তি লাগবে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

নকশাগত পরিবর্তন আসায় সেতুর নির্মাণ খরচ বেড়ে গেছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। সড়ক নির্মাণের শুরুতে কিছু এলাকায় নালা-নর্দমা নির্মাণ করা হয়নি। কিন্তু এখন বৃষ্টির সময় রাস্তায় পানি জমে থাকছে। এতে সড়কের পিচ (কার্পেটিং) নষ্ট হচ্ছে। এ জন্য নতুন করে নালা নির্মাণ করতে হবে। এতে বাড়তি লাগবে ১৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

রাতের বেলায় সড়কটি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ জন্য এলইডি বাতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই খাতে বাড়তি খরচ হবে সাড়ে ৫ কোটি টাকা।

পাহাড়ের ঢাল স্থিতিশীল করতে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণে অতিরিক্ত লাগবে সাড়ে ১০ কোটি টাকা। সড়ক নির্মাণে বাড়তি খরচ হবে আরও ৫ কোটি টাকা।

প্রকল্পে শুরুতে পরামর্শক ব্যয় ছিল সাড়ে ৪ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৮ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে বাড়তি খরচ প্রায় ৮৮ কোটি টাকা। তবে ভূমি অধিগ্রহণসহ কয়েকটি খাতে আগের হিসাবের তুলনায় ব্যয় কমেছে। এর পরিমাণ মোট ৫৫ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের বর্ধিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি টাকা।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পে নতুন করে সেতু নির্মাণসহ বাড়তি কিছু কাজ যুক্ত হয়েছে। এ জন্য প্রকল্প ব্যয় বেড়ে গেছে। বর্ধিত টাকা দিতে রাজি হয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। এই অর্থ সিডিএর নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করার নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু সিডিএর তহবিলে টাকা নেই। আবার সড়কটি রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ও আছে। তাই এখন টোল নেওয়া ছাড়া সিডিএর আর কোনো বিকল্প নেই।

কোন গাড়ির জন্য কত টোল

সংশোধিত ডিপিপির নথি অনুযায়ী, এই সড়ক দিয়ে চলতে হলে মোটরসাইকেলকে টোল দিতে হবে ১০ টাকা। তিন চাকার গাড়ির ১৫ টাকা। প্রাইভেট কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের ৫০ টাকা করে। পিকআপ ও মিনিবাসের ৮০ টাকা করে। বড় বাসের ১০০ টাকা। চার চাকার ট্রাকের ১২০ টাকা। ছয় চাকার ট্রাকের ১৫০ টাকা। ট্রেইলর বা কাভার্ড ভ্যানের টোল ধার্য করা হয়েছে ২০০ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরে কোনো সড়ক থেকে টোল আদায় করা হয় না। তবে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত আসা সড়ক থেকে টোল আদায় করা হয়। এই সড়ক দিয়ে মূলত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য বহনকারী গাড়ি চলাচল করে।

সমুদ্রের পাশে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সিটি আউটার রিং রোড নামে নতুন সড়ক নির্মাণ করেছে সিডিএ। এই সড়ক থেকেও কোনো টোল নেওয়া হয় না। অথচ এর চেয়ে কম দূরত্বের ও স্বল্প ব্যয়ের সড়ক থেকে টোল নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ।

সড়কটি থেকে টোল আদায়ের সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি সড়কের অধিকাংশ ব্যয় সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছে। এখন শেষের কিছু অংশের নির্মাণকাজের জন্য টোল নিতে হবে? মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। কেননা সরকারি তহবিলের টাকা তো জনগণেরই।’