আপনি কি পুরুষ? যদি হয়ে থাকেন, এই মহিলা বগিতে আপনাকে দেখতে পেলেই ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। তারপর ইংরেজিতে লেখা—নাউ ডিসিশন ইজ ইয়োরস। কয়েকটি জায়গায় কালো সাইনপেন দিয়ে মহিলা লিখতে গিয়ে কোনো জায়গায় শুধু ‘ম’ আছে, আবার কোনো জায়গায় ‘ম’ বাদ গিয়ে বাকিটুকু আছে। বাইরে থেকে কোথাও লেখা নেই বগি বা কামরাটি নারীদের জন্য সংরক্ষিত।
পুরুষ যাত্রীরা অনেকেই কামরার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন। আর তখন বগির নারী যাত্রীরা বলতে থাকেন, নামেন, এটা নারীদের কামরা। এ কথা শুনে অনেকে সহজেই নেমে যান, আবার অনেকে বগির গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন, বলেন বগির বাইরে তো কিছু লেখা নেই। আবার এক জায়গায় অনেক নারী- শুধু এটা দেখে মজা করার জন্যও অনেক পুরুষ যাত্রী ঢুঁ দেন কামরার ভেতরে। তবে পুরুষ যাত্রীর বিষয়ে বগির নারী যাত্রীরা কোনো আপস করেন না। এ কামরাকে নিজেদের কামরা বলে মনে করেন, তাই এ অধিকারে কোনোভাবেই ভাগ বসাতে দিতে চান না।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে লোকাল ট্রেনে নারীদের জন্য একটি কামরা সংরক্ষিত আছে। ২০ অক্টোবর ওই কামরায় ভ্রমণ করে এ চিত্র দেখা যায়।
সকাল ও বিকেলে অফিস শুরু ও শেষের সময় নারী যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় হয় কামরাটিতে। শিক্ষার্থী, নার্স, চাকরিজীবী, গৃহিণী—যাত্রীদের মধ্যে সবাই আছেন। গুঁতোগুঁতি করে, পা মাড়িয়ে একেক যাত্রী কামরায় ওঠেন এবং নামার সময়ও একই অবস্থা হয়। কারও কোলে কয়েক মাস বয়সী বাচ্চা। কেউ কেউ মুরগির খাঁচা, বস্তা বা বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে ট্রেনে যাত্রা করেছেন।
২০ অক্টোবর পৌনে পাঁচটার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার দিকে যাত্রা শুরু করে ট্রেনটি। বিভিন্ন স্টেশনে হুড়োহুড়ি করে ট্রেনে উঠতে গিয়ে নারী যাত্রীদের মধ্যে রাগারাগি, তর্কবিতর্ক শুরু হয়ে যায়। তবে একবার ঠেসেঠুসে ঢুকতে পারলে ঠিকই দাঁড়ানোর জায়গা হয়ে যায়। একটু আগে যে নারীরা ঝগড়া বা রাগারাগি করছিলেন, ট্রেন ছাড়লে দেখা গেল তাঁরাই গল্পে মশগুল হয়ে গেছেন। গল্পে সংসার, অসুখ-বিসুখ থেকে শুরু করে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়া কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না। যে যাত্রী সিটে বসতে পেরেছেন, তিনিই একটু সরে বসে আরেকজনকে বসতে বলছেন।
এ নারী কামরার শৌচাগারটি কবে নষ্ট হয়েছে, তা যাত্রীদের মধ্যে কেউ বলতে পারলেন না। তবে শৌচাগার থেকে আসা দুর্গন্ধে যাত্রীদের অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছিল।
আসন ফাঁকা নেই, শৌচাগার নষ্ট, তারপরও কেন এ কামরায় উঠলেন, এ প্রশ্নে প্রায় সব নারীর মুখেই হাসি। তাঁদের বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে, এ কামরাটি নারীদের জন্য বরাদ্দ। গুঁতোগুঁতি, ঠাসাঠাসি যা-ই হোক, কেউ যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন না। নিরাপদ বোধ করেন তাঁরা। আর যেহেতু স্বল্প দূরত্বে যাত্রীরা নামবেন, তাই শৌচাগার নষ্ট হলেও শুধু বাজে গন্ধ ছাড়া তেমন সমস্যা হচ্ছে না।
নারী যাত্রীদের দাবি, আরও বেশি ট্রেনে নারীদের জন্য কামরা নির্দিষ্ট করলে নারী যাত্রীদের সুবিধা হবে। এখন স্টেশনে এসে অপেক্ষা করতে হয়। আর ট্রেনের কামরাটি নোংরা থাকে, তা একটু পরিচ্ছন্ন থাকলে যাত্রীরা স্বস্তিতে যাতায়াত করতে পারবেন।
সরকারের জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে (২০২২-২০২৩) উল্লেখ করা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের পাশাপাশি তুরাগ এক্সপ্রেস এবং টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে নারী যাত্রীদের জন্য আলাদা কামরা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ফলে সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বাড়ছে।
তবে রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে এখন পর্যন্ত আলাদা কামরা চালু হয়নি। আর ঢাকা থেকে জয়দেবপুর রুটে চলাচলকারী তুরাগ এক্সপ্রেসটি তুলনামূলক উন্নত মানের, তাই নারীদের কামরাটিও ভালো। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের ট্রেনের মতো বেহাল নয়।
২০ অক্টোবর কমলাপুর স্টেশনের পাশে নারায়ণগঞ্জ প্ল্যাটফর্মে টিকিট কেটে অপেক্ষার সময় জানা গেল, বেলা সাড়ে তিনটায় যে ট্রেনটি স্টেশন থেকে ছাড়বে, সেটি চালাবেন দেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক সালমা খাতুন। ট্রেন ছাড়ার আগে সালমা খাতুন কীভাবে ট্রেন চালান প্রতিবেদক তা দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে সালমা খাতুন রাজি হন। জানালেন, গরমের জন্য তিনি এবং তাঁর পুরুষ সহকারী চালকের জন্য নির্ধারিত পোশাকটি পরে ট্রেন চালাতে পারেন না।
ছোট ইঞ্জিন রুমে বসে সালমা খাতুন ট্রেন চালানো শুরু করেন। তাঁর মুখের সামনে একদম ছোট একটি ফ্যান ট্রেনের যন্ত্রপাতির ওপর বসানো আছে। তাঁর সহকারী যেখানে বসেন, সেখানে তা-ও নেই। বাইরের ধুলা ও ট্রেনের কালো ধোঁয়া সালমা খাতুনের মুখে এসে লাগছিল। হর্নের বিকট শব্দ তো আছেই। ছোট চেয়ারে বাঁকা হয়ে বসে সামনে ও পেছনে দেখে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে ট্রেন চালাচ্ছিলেন সালমা খাতুন। বললেন, সুযোগ-সুবিধা যা-ই থাকুক, ট্রেনের এতগুলো যাত্রীর জানমালের দায়িত্ব থাকে চালকের কাঁধে। তাই দায়িত্বে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই।
১৮৯১ সালের রেল আইনের ৬৪ ধারা অনুযায়ী, যাত্রীবাহী প্রতিটি ট্রেনে একটি কামরা (কমপক্ষে সর্বাপেক্ষা নিম্ন শ্রেণির) শুধু নারীদের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে। ট্রেনের দূরত্ব ৫০ মাইলের বেশি হলে কামরায় একটি শৌচাগার থাকতে হবে। আর আইনটির ১১৯ ধারায় বলা হয়েছে, নারীদের জন্য সংরক্ষিত এটি জানার পরও বিনা অনুমতিতে কোনো পুরুষ এ কামরায় উঠলে ১০০ টাকা জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তি পাবেন।
১৮৯১ সালের আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে ২০২১ সালে একটি খসড়া করা হয়েছে, সেখানেও ট্রেনে নারীদের জন্য কামরা সংরক্ষণের বিষয়টি বহাল রাখা হয়েছে। জরিমানা বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা অনধিক এক বছরের জেল বা উভয় দণ্ডসহ বিভিন্ন শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মমতাজ পারভীন যাত্রীবাহী প্রতিটি ট্রেনে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কামরা বরাদ্দ রাখতে নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। এর আগে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর নারীদের জন্য আলাদা কামরা বরাদ্দ চেয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি একটি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন তিনি। রিটকারী গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি সম্পূরক আবেদন করেন। এর ওপর শুনানি নিয়ে গত বছর ১০ মার্চ আইনের বিধান অনুযায়ী যাত্রীবাহী প্রতিটি ট্রেনে নারী যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট কামরা বরাদ্দ রাখতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দেন হাইকোর্ট। নারী যাত্রীদের জন্য ট্রেনে নির্দিষ্ট কামরা সংরক্ষণসংক্রান্ত রেলওয়ে আইনের ৬৪ ও ১১৯ ধারা বাস্তবায়নে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, তাঁর জানা মতে, আন্তনগর ট্রেনে নারীদের জন্য আলাদা কামরা নেই। তবে প্রতিটি ট্রেনে নারীদের জন্য আলাদা কামরা থাকার বিষয়ে একমত পোষণ করেন সচিব।