ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার ছাত্রী অপরাধের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করে উদাহরণ তৈরি করেছেন বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা।
ভয়ের সংস্কৃতি রুখে দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদের প্রতীক’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার ছাত্রী। এমনটা মনে করেন দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে। তাঁরা মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের দাপট ও বেপরোয়া আচরণের মধ্যে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া একজন ছাত্রী অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে নির্যাতনের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া ছাত্রী ফুলপরী খাতুন। ভুক্তভোগী এই ছাত্রী নীরব না থেকে তাঁকে বিবস্ত্র করে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করার ঘটনা প্রকাশ্যে এনেছেন। এ ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্রলীগের একজন নেত্রী এবং তাঁর অনুসারীরা জড়িত বলে তিনি অভিযোগ এনেছেন।
নির্যাতনের শিকার এই ছাত্রী যেভাবে সাহস করে প্রতিবাদ করেছেন, তা নিয়ে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। এই শিক্ষকেরা তাঁদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।
ছাত্ররাজনীতিতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে আশির দশক থেকে। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে তা বেড়ে চলেছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি যতটুকু প্রকাশ হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে এটি ছিল সীমাহীন নির্যাতনের ঘটনা।আবুল কাসেম ফজলুল হক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক
যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁরা হলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম, নাজিয়া চৌধুরী, রায়হান রাইন, ফরিদ উদ্দিন খান ও মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান।
তাঁরা মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের দাপট ও বেপরোয়া আচরণের মধ্যে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া একজন ছাত্রী অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাঁরা নির্যাতিত হন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই ভুক্তভোগী এবং তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে কেউ সাহস করেন না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের। তিনি বলেন, ভয়ের পরিবেশের কারণে এবং অনেক সময় স্বার্থের বিবেচনা থেকে শিক্ষকেরাও এখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেভাবে ভূমিকা রাখছেন না। এ ধরনের একটা পরিবেশের মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার ছাত্রী অপরাধের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করে উদাহরণ তৈরি করেছেন।
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, ছাত্ররাজনীতি এখন বদলে গেছে এবং সেখানে জায়গা করে নিয়েছে অপরাধমূলক কাজ। এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে দেওয়া উচিত কি না, সেটা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একজন নেত্রীর হাতে ওই ছাত্রী নির্যাতিত হয়েছেন, কুষ্টিয়ার সেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম মনে করেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী সমাজের চোখ খুলে দিয়েছেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে মনে করছেন, নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী অভিযোগ না তুললে বিষয়টি চাপা পড়ে থাকত। এখন পুরো দেশে বিষয়টি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরী বলেন, ওই ছাত্রী অভিযোগ করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সজাগ হয়েছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং আদালতও তদন্তের নির্দেশ নিয়েছেন।
সারা দেশে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের নিপীড়নের প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অনশনে বসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের দখলদারি, আসন-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ করে আসছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্রলীগের হাতে ছাত্রী নির্যাতনের প্রসঙ্গে ফরিদ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু প্রশাসন, সরকার বিষয়টি দেখেও দেখে না। শিক্ষাঙ্গনে অনাচার যে মাত্রায় গেছে, সেটি জাতির জন্য লজ্জার ও কলঙ্কের।
নির্যাতনের শিকার ছাত্রী একদিকে যেমন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছেন, ঠিক একইভাবে নারী হিসেবে পরিচয় গোপন রেখে আড়ালে থাকার প্রচলিত দেয়ালটিকে ভেঙে দিয়েছেন বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হান রাইন।
তবে প্রতিবাদ করার কারণে ওই ছাত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে যাতে কোনো শঙ্কা তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ থাকা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদ করার পর নিপীড়নের ধরনটা পাল্টে যায়। তাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েটি আরও নিরাপত্তাহীন হলেন কি না বা তিনি তাঁর সংগ্রাম কত দিন চালিয়ে যেতে পারবেন, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রীর অভিযোগের কারণে তাঁর ওপর নির্যাতনের ঘটনা যা প্রকাশ পেয়েছে, সেটা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের একটা চিত্র তুলে ধরে কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন শিক্ষকদের অনেকে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্ররাজনীতিতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে আশির দশক থেকে। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে তা বেড়ে চলেছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি যতটুকু প্রকাশ হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে এটি ছিল সীমাহীন নির্যাতনের ঘটনা। এই ঘটনা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, দেশের রাজনীতি ও সমাজ থেকে মানবিক গুণ নষ্ট হওয়ার কারণে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।