‘ছেলেকে টাকার জন্য পড়ালেখা করাতে পারি নাই। দুইটা মেয়েরে পালক দিছি ভাতের অভাবে। মেকানিকের কাজ শিখতে দিয়েছিলাম ছেলেরে। আমার বাবাটা যে শহীদ হবে, কে জানত। আমি তো তার জন্য ভাত নিয়ে অপেক্ষা করেছিলাম। ছেলে বলেছিল, মা রাস্তায় মিছিল হচ্ছে, একটু দেখেই চলে আসবে। এরপর বাবা আমার ফিরেছে রক্তে লাল হয়ে। আমার ছেলেটা অস্ত্রধারীও নয়, সন্ত্রাসীও নয়। তার ইচ্ছা ছিল মেকানিকের কাজ শিখে মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। তার আগেই আমাকে ছেড়ে চলে গেল।’
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানার সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত একমাত্র ছেলে মোহাম্মদ এয়াছিনকে (১৪) হারিয়ে শোকে পাথর মা লাকি বেগম অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন কথাগুলো। গত সোমবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে রাস্তায় স্লোগান শুনে দেখতে গিয়েছিল কিশোর এয়াছিন। সেদিন মিছিল থেকে জনতা সোনাইমুড়ী থানা আক্রমণ করে। থানা থেকে পুলিশের চালানো গুলিতে মিছিলে থাকা কিশোর-তরুণসহ কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হন। এয়াছিন ওই পাঁচজনের একজন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিজয় মিছিলটি থানার সামনে এলে অতি উৎসাহী কেউ কেউ থানার দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা কয়েকটি গুলি ছুড়ে জবাব দেয়। মুহূর্তেই থানার সামনে প্রধান ফটকের বাইরে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন এয়াছিনসহ দু-তিনজন। পরে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ে।
এয়াছিনের মা লাকি বেগম বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে। একটু মিছিল দেখতে গিয়েছিল। লতা-পাতা খেয়ে এই সন্তানদের মানুষ করেছি। মাছ-গোশত খাওয়াতে পারিনি। কখনো মুরগি খাওয়াতে পারিনি। দই খাওয়াতে পারিনি। একটু ভালো খাবারের জন্য পাগল ছিল আমার ছেলেটা। ভাতের কষ্টে ছোটবেলায় কাজে লাগিয়ে দিছি।’
প্রতিবেশীরা জানান, নিহত এয়াছিনের বাবা সোনাইমুড়ী উপজেলার ভানুয়াই গ্রামের নোয়াবাড়ির মো. হানিফ ওরফে বাবলু শারীরিকভাবে অসুস্থ। দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। এ কারণে কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। কিশোর এয়াছিন গ্যাসের চুলা, মোটর, বৈদ্যুতিক পাখা ও ফ্রিজ মেরামতের কিছু কাজ শিখেছে। ওই কাজ করে যে আয় হতো তা দিয়েই পরিবার চলত। এয়াছিনের চার বোনের মধ্যে দুজনকে অভাবের কারণে অন্যের ঘরে পালক দিয়েছেন। টাকার অভাবে এয়াছিনকে পড়ালেখা করাতে পারেননি। ইচ্ছা ছিল কোরআনে হাফেজ বানাবেন। অভাবের কারণে অল্প বয়সে কাজে দিয়ে দিয়েছে পরিবার।
প্রসঙ্গত, ৫ আগস্ট সোমবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সোনাইমুড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিল বের হয় সোনাইমুড়ী উপজেলা সদরে। মিছিলে ঢুকে যায় অনেক উৎসুক শিশু-কিশোরও। বিকেল আনুমানিক পৌনে পাঁচটার দিকে মিছিল থেকে কিছু উৎসাহ ব্যক্তি সোনাইমুড়ী থানার দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। তখন পুলিশ পাল্টা গুলি করলে তিন পুলিশসহ আটজন নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন কমপক্ষে ৪০ জন।