বান্দরবানের রুমায় নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা সোনালী ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির আগে স্থানীয় মসজিদ থেকে ব্যাংকের শাখাটির ব্যবস্থাপককে ধরে নিয়ে যায়। এরপর ব্যাংকে ঢুকে ভল্টে থাকা টাকা নিয়ে যায় তারা।
ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। রুমা উপজেলা মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্ত্রধারী ২০ থেকে ২৫ জন মসজিদে ঢুকে পড়ে। তখন আমরা সবাই এশার নামাজে ছিলাম। ফরজ নামাজ শেষ করে দেখলাম সবার মুঠোফোন নিয়ে নিচ্ছে তারা।’
নুরুল ইসলাম আরও বলেন, কেএনএফ সদস্যরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে খুঁজতে থাকে। একপর্যায়ে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।
রুমায় কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যরা গতকাল মঙ্গলবার রাত সোয়া আটটার দিক থেকে ঘণ্টাখানেক সময় ধরে ডাকাতি করে। রুমা উপজেলার পরিষদ চত্বর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, কেএনএফের সদস্যরা দুটি এসএমজি (লাইট মেশিন গান) ও ৬০টি গুলি, ৮টি চীনা রাইফেল ও ৩২০টি গুলি, ৪টি শটগান ও ৩৫টি কার্তুজ এবং সোনালী ব্যাংকের শাখার দুটি ভল্টের একটি ভেঙে রক্ষিত টাকা নিয়ে গেছে। টাকার পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
অবশ্য সোনালী ব্যাংক বান্দরবান অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক মোহাম্মদ ওসমান গণি মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, রুমা শাখায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা থাকার কথা।
এদিকে বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, লুট হওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
আজ বুধবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, বান্দরবান রুমা সড়কের রুমা উপজেলা পরিষদের ২০০ গজ দূরে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখা। তার পাশে উপজেলা মসজিদ। আশপাশে সব উঁচু উঁচু পাহাড়।
মঙ্গলবার রাতে ডাকাতির পর ব্যাংক ও উপজেলা পরিষদের সামনে পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। রয়েছেন র্যাবের সদস্যরাও। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন, জেলা পুলিশ সুপার শাহিন সৈকতসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বান্দরবান রুমা সড়কের উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে ঢোকার মুখে রয়েছে একটি দোতলা ভবন। এটির নিচতলায় থাকেন সরকারি কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় তলার এক পাশে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখা। আরেক পাশে থাকেন ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১০ জন পুলিশ সদস্য।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কনস্টেবল রূপন শীল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আর কনস্টেবল তৌহিদ ব্যাংকের সামনে পাহারায় ছিলাম। হঠাৎ দেখি ইউনিফর্ম পরা অস্ত্রধারী কয়েকজন। তারা আমাদের ব্যারাকে ঢুকিয়ে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাতে থাকা অস্ত্র ও মুঠোফোন নিয়ে নেয়।’ তিনি বলেন, সব পুলিশ সদস্যকে মাথা নিচু করে বসিয়ে রাখা হয়। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা ব্যারাকে আটকে রাখা হয়।
সোনালী ব্যাংকের শাখায় আজ দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাংকের টেবিলের কাচ ভাঙা। ভল্টের কক্ষটি এলোমেলো। সিআইডির (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ) ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করছেন।
ভবনটির নিচতলায় থাকা রুমা উপজেলার সরকারি একটি সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারীরা ইউনিফর্ম (নিজেদের একই রকমের পোশাক) পরা ছিল। পোশাকে কেএনএফ লেখা ছিল।
সোনালী ব্যাংক থেকে ২০০ গজ উত্তরে রুমা উপজেলা পরিষদ ভবন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবন। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন আটজন আনসার সদস্য।
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর চট্টগ্রামের উপমহাপরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ রাসেল ঘটনাস্থলে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দায়িত্বরত আটজন আনসার সদস্যের মধ্যে চারজন আহত হয়েছেন। তাঁদের ৪টি শটগান ও ৩৫টি গুলি লুট করে অস্ত্রধারীরা। তিনি আরও বলেন, আনসার সদস্যরা ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন না। ব্যাংকে হামলা চালালে আনসার সদস্যরা প্রতিরোধ করতে পারেন, সে জন্য অস্ত্রধারীরা আগেই আনসার সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁদের অস্ত্র ও গুলি লুট করে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ডাকাতিতে শতাধিক কেএনএফ সদস্য অংশ নেয়। তাদের বেশির ভাগের পরনে ইউনিফর্ম ছিল।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ব্যাংক লুটের আগে অস্ত্রধারীরা বান্দরবান-রুমা সড়কের উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনের অংশে দুই পাশে ব্যারিকেড দেয়। এলাকাটি নির্জন এবং ঘটনার সময় বিদ্যুৎ ছিল না।
কেনএনএফের অস্ত্রধারীরা যাওয়ার সময় সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজামুদ্দিনকে নিয়ে যায় বলে স্থানীয় লোকজন বলছেন। আজ দুপুর পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এদিকে নিজামুদ্দিনকে অক্ষত উদ্ধার এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার দাবিতে আজ বেলা ১১টার দিকে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে রুমা উপজেলা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদ। উপজেলা পরিষদ এলাকায় এই মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি সুকান্ত দেব, সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বড়ুয়া প্রমুখ।
রুমা উপজেলা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদের সভাপতি সুকান্ত দেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চরম আতঙ্কের মধ্যে আছি।’
এদিকে আজ বেলা একটার দিকে বান্দরবানের থানচি উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের দুটি শাখায় ডাকাতি করে অস্ত্রধারীরা।
থানচি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অং প্রু ম্রো প্রথম আলোকে বলেন, বেলা একটার দিকে থানচি সদরের শাহজাহানপুরের দিক থেকে তিনটি চাঁদের গাড়িতে করে সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে বাজার এলাকায় প্রবেশ করে। এরপর থানচি উচ্চবিদ্যালয়–সংলগ্ন সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে নগদ টাকা যা পেয়েছে, তা নিয়ে চলে যায়।
কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতিপূর্বে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল।
সেই আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় বেথেলপাড়ায়।