এবারের ঈদযাত্রায় আন্তনগর ট্রেনের সব টিকিট অনলাইনে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। আগামী শুক্রবার থেকেই অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হবে। রেলওয়ে বলছে, ঈদের টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার দুর্ভোগ কমাতে এবং কালোবাজারি বন্ধে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রেলের এ সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রীয় এই গণপরিবহন দেশের শিক্ষিত ও তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের বাহনে পরিণত হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। কারণ, দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। কিন্তু এবার ঈদে ১৩ থেকে ১৪ লাখ মানুষ ট্রেনের টিকিট কাটতে পারবেন, যাঁরা রেলের নিবন্ধিত গ্রাহক। অন্যদিকে যাঁদের ই–মেইল আইডি নেই, রেলের অ্যাপ ও অনলাইনে নিবন্ধন করেননি অথবা করতে পারেননি, তাঁরা টিকিট কাটার সুযোগ পাবেন না।
সব মিলিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের কিংবা গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য রেলের টিকিট কাটা কঠিন হয়ে গেল।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, এবার ঈদে পরীক্ষামূলকভাবে সব টিকিট অনলাইনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী মে মাস থেকে স্থায়ীভাবে টিকিট অনলাইনে বিক্রির পরিকল্পনা আছে কর্তৃপক্ষের। তবে এর পেছনে অন্য উদ্দেশ্য দেখছেন রেলের কোনো কোনো কর্মকর্তা। তাঁদের দাবি, সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি করা হলে লাভবান হবে রেলওয়ে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সহজ ডট কম, সিনেসিস ও ভিনসেন মিলে গঠিত যৌথ কোম্পানি। কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করলে তারা প্রতিটি টিকিটের বিপরীতে ২৫ পয়সা পায় (সফটওয়্যার ব্যবহার বাবদ)। কিন্তু অনলাইনে টিকিট বিক্রির জন্য চার্জ (মাশুল) হিসেবে গ্রাহকের কাছ থেকে তারা ২০ টাকা নেয়। দিনে রেলওয়ে যদি অনলাইনে ৭৫ হাজার টিকিট বিক্রি করে, তাহলে গ্রাহকের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা বাড়তি পাবে কোম্পানিটি।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সহজ, সিনেসিস ও ভিনসেনের যৌথ কোম্পানি দায়িত্ব নেওয়ার পরই ২০২২ সালের ২৬ মার্চ থেকে রেলের টিকিট কেনার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) মাধ্যমে অনলাইনে নিবন্ধন শুরু হয়। অবশ্য তখন তা ছিল ঐচ্ছিক। জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্মনিবন্ধন নম্বর দিয়ে অনলাইনে নিজের অ্যাকাউন্ট যাচাই (ভেরিফিকেশন) করার ব্যবস্থা চালু হয় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। গত ১ মার্চ থেকে নিবন্ধন এবং যাচাই করা—দুটিই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে যাচাই করে নিবন্ধিত ব্যক্তি ছাড়া কেউ আন্তনগর ট্রেনের টিকিট কাটতে পারবেন না।
রেলওয়ের হিসাবে, গত ২৬ মার্চ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে যাচাই করে নিবন্ধন নিয়েছেন ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৬৯ জন মানুষ। অর্থাৎ, ঈদে শুধু তাঁরাই টিকিট কাটতে পারবেন। একজন সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কাটতে পারবেন। মানে হলো, নিজে অথবা স্বজনদের মাধ্যমে টিকিট কেটে ভ্রমণের সুযোগ হবে প্রায় ৫৩ লাখ মানুষের। দেশের জনসংখ্যা অবশ্য প্রায় ১৭ কোটি (শিশুসহ)।
যাত্রীচাহিদা ও টিকিটের সংখ্যা
রেলে বর্তমানে ১০৪টি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। এসব ট্রেনে আসন আছে কমবেশি ৭৮ হাজার। কিছু ট্রেনের সাপ্তাহিক বিরতি থাকে। সব মিলিয়ে দিনে ৭৫ হাজারের মতো আসনের বিপরীতে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা আছে।
এবারের ঈদে ঢাকা থেকে যেসব ট্রেন চলাচল করবে, তার আসনসংখ্যা ২৫ হাজার ৭৭৮। এর বাইরে তিনটি বিশেষ ট্রেন চলাচল করবে। এসব ট্রেনের আরও প্রায় তিন হাজার টিকিট ঢাকা ও জয়দেবপুর স্টেশনের অধীনে অনলাইনে বিক্রি করা হবে। অর্থাৎ এবারের ঈদে ২৮ হাজার ৭৭৮ জন যাত্রী প্রতিদিন ঢাকা ও জয়দেবপুর থেকে আসনে বসে যাতায়াত করতে পারবেন।
কেউ কেউ বলছেন, আগামী শুক্রবার বিক্রি শুরুর পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই টিকিট শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। অনলাইন ব্যবস্থায় যিনি আগে প্রবেশ করতে পারবেন, তিনিই টিকিট পাবেন। আবার এমন হওয়ার আশঙ্কা আছে যে সবাই একসঙ্গে প্রবেশ করতে চাওয়ায় ‘সার্ভার ডাউন’ হয়ে গেল।
২০২২ সালে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে অর্ধেক টিকিট অনলাইনে বিক্রি করা হয়েছিল। সে সময় অনেকেই অনলাইন ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে না পারার অভিযোগ করেছিলেন। গত মাসে রেলভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দুর্ভোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সহজ ডটকমের প্রতিনিধিকে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেন। ওই সময় বলা হয়, এবার সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। দুর্ভোগ হবে না।
সক্ষমতা যতই বাড়ানো হোক, যাঁরা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না, যাঁদের ইন্টারনেট সুবিধা নেই, তাঁদের টিকিট পাওয়া কঠিন হবে। দেশের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ। বাকিদের জন্য টিকিট কাটার ব্যবস্থা নেই। তাদের হয় অন্যদের মাধ্যমে টিকিট কাটাতে হবে, সে জন্য নিবন্ধিত পরিচিতজন থাকতে হবে। অথবা দোকানে যেতে হবে, যেখানে টাকার বিনিময়ে নিবন্ধন করে টিকিট কাটা হয়। আবার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি রাখতে হবে, যা ট্রেনে যাচাই করে দেখবেন পরিদর্শকেরা। টিকিটে দেওয়া নামের যাত্রীই ভ্রমণ করছেন কি না, তা–ও যাচাই করা হবে।
কিছু কিছু টিকিট সংরক্ষিত থাকবে। রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রতিবন্ধী ও বিভিন্ন বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে মোট টিকিটের ২ শতাংশ। বিচারপতি, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য অথবা প্রভাবশালীদের জন্য আলাদা কোটা নেই। তাঁদের চাহিদা মেটাতে ৫৩টি কোচ প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলো প্রয়োজনে যুক্ত করা হবে। আগে এসব অতিরিক্ত কোচের কিছু টিকিট সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে বিক্রি করা হতো।
যাঁরা অনলাইনে টিকিট কাটতে পারবেন না, তাঁদের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে রেলওয়ে। প্রতিটি ট্রেনের শোভন শ্রেণি (নন-এসি) আসনের ২৫ শতাংশ টিকিট বিক্রি করা হবে আসনবিহীন, অর্থাৎ দাঁড়িয়ে যেতে হবে। এসব টিকিট স্টেশনের কাউন্টার থেকে কেনা যাবে।
কার লাভ, কার ক্ষতি
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সম্প্রতি এই প্রতিবেদককে অনলাইনে সব টিকিট বিক্রির পক্ষে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ চিন্তার পাশাপাশি বাস্তবিক দুটি কারণের কথা বলেছেন—১. কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করলে হাজার হাজার মানুষ আগের দিন থেকে বা কয়েক ঘণ্টা আগে লাইনে দাঁড়ান। চাহিদার তুলনায় টিকিট কম থাকায় তাঁদের অনেককে ফেরত যেতে হয়। একজন মানুষকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে টিকিট নেই বলাটা অশোভন। ২. কালোবাজারি বন্ধে অনলাইন টিকিট বিক্রির বিকল্প নেই।
এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যাতে কষ্ট না করা হয়, সে জন্য অনলাইনে সব টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ। কিন্তু লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, কীভাবে রেলের টিকিটের সংখ্যা বাড়ানো যায়। গত এক যুগে সরকার রেলে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। তবে ট্রেনের আসনসংখ্যা তেমন একটা বাড়ছে না। টিকিটের তুলনায় চাহিদা বেশি হওয়ায় অনিয়মের অভিযোগ থেকেই যাচ্ছে।
কালোবাজারির দায় কার
রেলের যাত্রী ও মালামালের নিরাপত্তা এবং টিকিট কালোবাজারিসহ সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে রেলওয়ে পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশের একটা অংশ এই দায়িত্ব পালন করে (জিআরপি)। তবে তাঁদের বেতন-ভাতা হয় রেলওয়ে থেকে। এটাকে রেল দীর্ঘদিন ধরে বাড়তি ব্যয় হিসেবে দেখে আসছে।
রেলওয়ে পুলিশকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর, পাকশী ও খুলনা। দেশে রেলওয়ে থানা ২৪টি এবং রেলওয়ে ফাঁড়ি ৩৩টি। সব মিলিয়ে রেলওয়ে পুলিশের জনবল ২ হাজার ৪৩২ জন। এর বাইরে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) রয়েছে। এর সদস্যদের নিয়োগ, বেতন-ভাতা ও অবসর সুবিধাসহ সবই বহন করে রেলওয়ে। আরএনবির সদস্যসংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো।
সব মিলিয়ে নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকেন সাত হাজার সদস্য। রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন প্রায় ২৫ হাজার। তাঁদের দিয়ে টিকিট কালোবাজারি কেন ঠেকানো যায় না? কর্মীদের অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করতে না পেরে রেলওয়ে কেন মানুষের জন্য টিকিট কাটা কঠিন করে ফেলছে, সেই প্রশ্নও উঠছে। আরেকটি প্রশ্ন হলো, টিকিট যদি অনলাইনে বিক্রি হয়, তাহলে প্রতিটি স্টেশনে টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা বুকিং ক্লার্ক ও সহকারী ক্লার্কদের কী হবে? তাঁরা কী বসে বসে বেতন পাবেন?
কেউ কেউ বলছেন, টিকিট বিক্রির যে ব্যবস্থা রেল করেছে, সেটা ভালো। তবে তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা ও ইন্টারনেট সুবিধাহীন মানুষের জন্য রেলেওয়ের টিকিট কাটার ব্যবস্থা রাখা উচিত। সে জন্য টিকিটের একটা অংশ সরাসরি কাটার ব্যবস্থা রাখতে হবে। হতে পারে সেটা স্বল্প দামের টিকিট।