বানের পানিতে একটু আশ্রয়ের আশায় একটি ইঁদুর
বানের পানিতে একটু আশ্রয়ের আশায় একটি ইঁদুর

অন্য প্রাণীরও সমান বিপদ

কুমিল্লার গোমতী নদীতে ভীষণ স্রোতে একটি টিনের চালা ভেসে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক হাতের এই চালায় ঠাঁই হয়েছে বেশ কয়েক জাতের প্রাণীর। গিরগিটি, সাপ আর একটি কুকুরের বাচ্চা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে শুধু মানুষ নয়, অন্য প্রাণীরও সমান বিপদ। ফেনীতে এ বন্যায় আটকা পড়েছে একটি বড় অজগর। বানের পানিতে টিকতে না পেরে বাড়ির উঠানে জায়গা করে নিয়েছে। নদীর প্রাণ একটি শুশুক ঢুকে পড়েছে একটি ছোট্ট ডোবায়। মুখে জাল পেঁচিয়ে গেছে। একটি বনবিড়াল মানুষের উঠানে আশ্রয় নিতে গিয়ে মারা পড়েছে। মানুষ কথা বলতে পারে, ত্রাণ পায়, প্রযুক্তি সহায়তায় নিরাপদ স্থানের সন্ধান করতে পারে। প্রাণীদের জন্য এই ব্যবস্থা নেই। তাই গত কয়েক দিন যত মানুষ মারা গেছে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রাণীদের। গৃহপালিত প্রাণীর সঙ্গে সঙ্গে বুনো প্রাণীরও মৃত্যু হয়েছে, নিজেদের বসতিও ধ্বংস হয়েছে।

দাঁড়াশ, গোখরাসহ বেশ কয়েক জাতের সাপ ঘরের ভেতর জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করবে। নিজেরা সাপ দেখে ভয় পেলে এই সাপগুলোকে মেরে না ফেলে ঘর থেকে বের করে দিয়ে নিরাপদে থাকুন।

কোন প্রাণীদের ক্ষতি বেশি হয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। পাখিদের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। ডানা থাকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যায়। বুনো সব ধরনের স্তন্যপায়ী, বিশেষ করে শিয়াল, বুনো বিড়াল, খরগোশ, বাগডাশ, ইঁদুরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরা খুব বেশি সময় সাঁতার কাটতে পারে না। তাই পরিত্যক্ত বাড়ির কোনায় এই প্রাণীগুলো জায়গা নিতে পারে। তাদের পিটিয়ে বের করে না দিয়ে প্রাণীগুলো বাঁচার জন্য আশ্রয় দিন। বেশ কয়েক জাতের সাপও দেখা যাবে মানুষের আশপাশে। বিশেষ করে যে সাপগুলো স্থলেই বেশি থাকতে পছন্দ করে। দাঁড়াশ, গোখরাসহ বেশ কয়েক জাতের সাপ ঘরের ভেতর জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করবে। নিজেরা সাপ দেখে ভয় পেলে এই সাপগুলোকে মেরে না ফেলে ঘর থেকে বের করে দিয়ে নিরাপদে থাকুন।

বুনো প্রাণী ছাড়াও সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে গৃহপালিত প্রাণী। গরু, ছাগল বা ভেড়া মানুষ তাদের সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করে। খাবারও দেয়। কিন্তু পাড়ার কুকুর বা বিড়ালের কোনো খবর নেওয়ার লোকের সংখ্যা একেবারেই কম। এই প্রাণীগুলোও বিপদে পড়েছে। মানুষের চেয়েও এরা বেশি বিপদে পড়েছে। তাদের জন্য ত্রাণ যায়নি। উদ্ধার করার জন্য কোনো নৌকা বা যানবাহন যায়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রাণী মারা পড়ে। গত কয়েক দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা খবরের কাগজে লাখো মানুষের উদ্ধারের ছবি দেখার বিপরীতে মাত্র একটি কুকুরের ছবি দেখেছি। দুজন নারী কুকুরটিকে উদ্ধার করছেন। কুকুরটি উদ্ধার হয়েছে কুমিল্লার বুড়িচং থেকে। ছবিটি দেখে চোখ জুড়ে যায়। একটি গ্রামে মানুষের বসবাসের চেয়ে অন্য প্রাণীর সংখ্যা নিশ্চয় বেশি। বেশির ভাগ প্রাণীই কোনো না কোনোভাবে মানুষেরই উপকারে আসে। এই দুর্দিনে তাদের সঙ্গেও ভালো আচরণ করা জরুরি।

আজ যেসব ত্রাণ যাচ্ছে মানুষের জন্য, তার অন্তত এক ভাগ হোক অন্য প্রাণীর জন্য। এক ভাগ মানুষ যেন প্রাণীদের উদ্ধারেও নিয়োজিত থাকে, এ আশা আমার।
বানের সময় একটি মেছো বিড়াল মানুষের উঠানে আশ্রয় নিলে মারা পড়ে

বানের পর যেসব প্রাণী বেঁচে যাবে, তারা খুবই ক্ষুধার্ত থাকবে। শুকনো জায়গা পেলেই তারা আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করবে। এ সময়ই মানুষের সঙ্গে প্রাণীর সংঘর্ষ বাড়বে। এ সময় মানুষকে বেশি সহনশীল হতে হবে। প্রাণীদের নিজেদের উঠানে জায়গা না দিলেও নিরাপদ জায়গায় রেখে আসুন। সম্ভব হলে খাবারের ব্যবস্থা করুন।

এ দেশে যত দুর্যোগ হয়, তার জন্য সম্পূর্ণ পুনর্বাসন হয় মানুষকে কেন্দ্র করে। পৃথিবীর উন্নত দেশে এর ব্যতিক্রম আছে। প্রাণিসেবার জন্যও এক দল মানুষ কাজ করে। খাবার নিয়ে যায়। অস্থায়ী উদ্ধারকেন্দ্র তৈরি করে। আমাদের দেশেও এর প্রচলন করতে হবে। আজ যেসব ত্রাণ যাচ্ছে মানুষের জন্য, তার অন্তত এক ভাগ হোক অন্য প্রাণীর জন্য। এক ভাগ মানুষ যেন প্রাণীদের উদ্ধারেও নিয়োজিত থাকে, এ আশা আমার।

আশার কথা হলো, বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট প্রস্তুত আছে প্রাণিসেবা দিতে। খুব ছোট পরিসরে কাজ শুরু করছে প্রাণিসেবী নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মজিব রহমান এই ইউনিটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন এক দল তরুণ প্রাণিপ্রেমী। বন্যা–পরবর্তী সময়ে তাঁরা তিন মাস কাজ করবেন প্রাণী পুনর্বাসন নিয়ে। এ ছাড়া আস সুন্নাহ ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনও প্রাণীদের খাবার পরিবেশন করছে। যেকোনো প্রাণী আটকা পড়লে তাদের ফোন করে খবর দিতে পারেন। তরুণদেরও অনুরোধ করব, তাঁরাও যেন প্রাণিসেবায় এগিয়ে আসেন।

  • সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণিগবেষক