কম মূল্যে পণ্য কিনতে নগরের বিভিন্ন স্থানে থাকা টিসিবির ট্রাকের সামনে প্রতিদিন ভিড় করছেন মানুষ। গতকাল বেলা দেড়টায় চট্টগ্রাম নগরের জামালখান এলাকায়
কম মূল্যে পণ্য কিনতে নগরের বিভিন্ন স্থানে থাকা টিসিবির ট্রাকের সামনে প্রতিদিন ভিড় করছেন মানুষ। গতকাল বেলা দেড়টায় চট্টগ্রাম নগরের জামালখান এলাকায়

টিসিবির পণ্য বিক্রি

সারিতে দ্বিগুণ মানুষ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা

দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় এলাকায় থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী মামুনুল ইসলাম। মাসের শেষের দিকে এসে সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন গত এক সপ্তাহ। সবশেষ ধার নিয়ে তিনি এসেছেন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে। তিনবার সারি থেকে ছিটকে পড়ে চতুর্থবারের চেষ্টায় তিনি চাল-ডাল কিনতে পেরেছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে নগরের জামালখান এলাকায় টিসিবির ট্রাকের সামনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, দুপুর ১২টার দিকে সারিতে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ট্রাক আসার পর ধাক্কাধাক্কিতে তিনবার সারি থেকে ছিটকে পড়েন। অন্যদের সহায়তায় আবার সারিতে দাঁড়ান তিনি। চাল-ডাল নিতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় দুই ঘণ্টা।

চট্টগ্রামে প্রায় এক মাস ধরে টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রম চলছে। এতে প্রতিদিন (শুক্রবার ছাড়া) সাত হাজার মানুষ চাল, ডাল ও ভোজ্যতেল কিনতে পারছেন। গতকাল নগরের ২১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের ২০টি পয়েন্টে পণ্য বিক্রি হয়েছে। নগরের জামালখান ওয়ার্ডে এদিন পণ্য বিক্রি করেছে মেসার্স সুপর্ণা স্টোর। এদিন ৩৫০ জনের জন্য চাল, ডাল ও তেল বরাদ্দ ছিল ট্রাকে।

সরেজমিনে জামালখান মোড়ে বেলা আড়াইটার দিকে দেখা যায়, ট্রাকের পেছনের নারী ও পুরুষের সারি মিলিয়ে তখনো ১৫০ জনের বেশি মানুষ। তবে ট্রাকে পণ্য ছিল ৫০ জনকে দেওয়ার মতো। সারির বাইরে আশপাশেও মানুষের জটলা। পাশের ফুটপাতে থাকা আসনেও অন্তত ২০ জন নারী বসে ছিলেন। এ সময় কয়েকজন ক্রেতা অভিযোগ করেন, সারির বাইরে থেকে নিজেদের পছন্দের মানুষকে পণ্য দিচ্ছেন পরিবেশকেরা।

মেসার্স সুপর্ণা স্টোরের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ দাশ প্রথম আলোকে বলেন, সারিতে বরাদ্দের চেয়ে ১৫০-২০০ জনের বেশি মানুষ থাকেন। সবাইকে দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই অনেককে খালি হাতে ফিরতে হয়।

সারিতে হট্টগোল, অনিয়মের অভিযোগ

বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে ২০টি পয়েন্টে টিসিবির কার্যক্রম শুরু হয়। এর পর থেকে ট্রাকের পেছনে মানুষের সারি বাড়তে থাকে। জামালখান এলাকায় বেলা একটার দিকেও তিন-চার শ মানুষ ছিলেন। ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই পণ্য পাবেন না দেখে চলে গেছেন। এক সপ্তাহ ধরে যাঁরা পণ্য দিচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের পছন্দের মানুষকে আলাদা করে পণ্য দিচ্ছেন। ফলে সারিতে দাঁড়িয়েও পণ্য পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।

গত সোমবার চেরাগী মোড়ে পণ্য বিক্রি করেছেন মেসার্স কনিষ্ঠা গ্রোসারি শপ। এদিন ট্রাকের পাশ থেকে কয়েকজনকে পণ্য দিতে দেখা যায় ট্রাকে থাকা পরিবেশকদের। এ সময় জানতে চাইলে পরিবেশকেরা কোনো জবাব দেননি। ক্রেতাদের অভিযোগ, প্রায়ই রাজনৈতিক পরিচয়ে কয়েকজন এসে পণ্য রেখে দেওয়ার জন্য বলে যান। তাঁদের সারির বাইরেই পণ্য দেন পরিবেশকেরা।

এ বিষয়ে জানতে মেসার্স কনিষ্ঠা গ্রোসারি শপের পরিবেশকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তবে নাম প্রকাশ না করে টিসিবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমানে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা নেই। গত ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে লোকজন এসে পণ্যের জন্য পরিবেশকদের চাপ দেন।

আগে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে টিসিবির কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তবে বর্তমানে কাউন্সিলররা না থাকায় বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। এ বিষয়ে জামালখান ওয়ার্ড সচিব পারভেজ কবির প্রথম আলোকে বলেন, চাপ দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তবে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা আসেন মাঝেমধ্যে। তাঁরা পণ্য বিতরণে সহায়তা করেন। তাঁদের জন্য পণ্য রেখে দেওয়ার জন্য বলেননি।

আগামী মাস থেকে বাড়ছে বরাদ্দ

টিসিবির পণ্য কেনার সারিতে আগে একসময় কেবল স্বল্প আয়ের মানুষের দেখা মিলত। এখন আগের পরিস্থিতি নেই। নগরের বিভিন্ন ট্রাক সেল পয়েন্টে গিয়ে অটোরিকশাচালক থেকে শুরু করে গৃহিণী, ক্ষুদ্র দোকানি, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্কুলশিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দেখা মিলছে। তাঁদের প্রত্যেকের দাবি, বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত।

সারিতে থাকা ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের প্রত্যেকেরই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। আয়ের তুলনায় অন্তত পাঁচ হাজার টাকার ঘাটতি থাকে গড়ে। অধিকাংশই ঋণ করতে ও সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। যাঁদের আয় ১৫-২৫ হাজারের মধ্যে, তাঁরা যেমন দুশ্চিন্তায় আছেন, তেমনি যাঁদের আয় ৩০-৪০ হাজারের ঘরে, তাঁদেরও একই দুশ্চিন্তা।

চট্টগ্রামে বর্তমানে নগরের ২০টি স্থানে ট্রাকে করে ৭ হাজার ভোক্তার কাছে চাল, ডাল ও তেল বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। টিসিবির নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে প্রতি মাসে ‘পরিবার কার্ডের’ মাধ্যমে চট্টগ্রামের ৫ লাখ ৩৫ হাজার ভোক্তার কাছে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। আগামী রোববার থেকে ট্রাকে বরাদ্দ ৩৫০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ করা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন টিসিবি চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা।

টিসিবি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে ৫০ জনের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, তবে এখনো প্রজ্ঞাপন হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে সারির বাইরে পণ্য দিতে ওয়ার্ড সচিব ও পরিবেশকদের ওপর চাপ দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে। সেখানে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।