জয়ী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মিনিতা রহমান এসেছে তার বাবা আরিফুর রহমানের সঙ্গে। মিনিতা নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
কুয়াশার ঘোর তখনো কাটেইনি ভালো করে। তার ওপর বইছে কনকনে হাওয়া। মিনিতার মতো অনেকেই তাদের অভিভাবকদের নিয়ে একে একে এসে উপস্থিত হচ্ছিল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। নিজেদের এলাকায় তারা বিতর্ক করে জয়ী হয়ে এখন যুক্তিতর্কের যুদ্ধে লড়তে এসেছে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে।
আজ শনিবার সকাল থেকেই দারুণ উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে নবীন প্রজন্মের বিতার্কিকেরা মেতে উঠছে শাণিত যুক্তি, বুদ্ধির দীপ্তি আর বাক্শৈলীর প্রয়োগে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে ‘পুষ্টি-প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা’য় বিজয়ের গৌরব অর্জন করার যুদ্ধে। সকাল ৯টায় জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার পতাকা উত্তোলনের ভেতর দিয়ে শুরু হয়েছে এই আয়োজন।
জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। বিতর্ক প্রতিযোগিতার পতাকা উত্তোলন করেন সহ–আয়োজক পুষ্টির (টি কে গ্রুপ) গ্রুপ পরিচালক মোস্তফা হায়দার। উপস্থিত ছিলেন সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও পেরেরা, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের উপাচার্য ও নাগরিক টিভির চেয়ারম্যান ড. রুবানা হক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও কথাশিল্পী মোহিত কামাল, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক। এ সময় অতিথিরা শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সবার কল্যাণ কামনা করেন।
এবার পুষ্টি-প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল এই সেন্ট যোসেফ স্কুল থেকেই গত বছরের ২৭ মে। তারপর সারা দেশের ৩৫টি জেলায় এবং রাজধানী ঢাকায় ৫টি এলাকায় আঞ্চলিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি জেলার শ্রেষ্ঠ দল ও ঢাকার পাঁচটি সেরা দল, এই ৪০ দল নিয়ে আজ হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। দলীয় বিতর্ক ছাড়া এতে রয়েছে বারোয়ারি বিতর্ক ও কুইজ।
আয়োজনের প্রচার সহযোগী নাগরিক টিভি এবং সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো বন্ধুসভা।
‘যোগ দাও যুক্তির মেলায়’ স্লোগান নিয়ে কয়েকটি ধাপে হচ্ছে প্রতিযোগিতা পর্ব। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বেলা ১১টায় শুরু হয়েছে প্রথম পর্বের প্রতিযোগিতা। এতে বিতর্কের বিষয় ছিল ‘তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার পাঠাভ্যাস নষ্ট করছে’। এই পর্বের বিজয়ীরা লড়বে দ্বিতীয় পর্বে। দ্বিতীয় পর্বের বিষয় ‘মাদক মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে পরিবার নয়, শিক্ষকদের ভূমিকাই প্রধান’। এই পর্বের বিজয়ীরা যাবে কোয়ার্টার ফাইনালে। বিতর্কের বিষয় ‘শিশুদের অনলাইনে নেতিবাচক আচরণের জন্য প্রধানত অভিভাবকই দায়ী।’ এখানে বিজয়ীরা সেমিফাইনালে লড়বে ‘প্রাথমিক পর্যায়েই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রীড়াশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত’ এই বিষয়ে। সেমির বিজয়ীদের জন্য চূড়ান্ত পর্বের বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা ‘এই সময়ে মেধাবী মানুষের চেয়ে মানবিক মানুষই বেশি দরকার’-এ বিষয়ে বিতর্ক করবে। আর বারোয়ারি বিতর্কের বিষয় হলো, ‘আমি যদি পাখি হতাম’।
উৎসব মঞ্চে আনুষ্ঠানিকতার সূচনা হয়েছিল পতাকা উত্তোলন পর্বের পর প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হকের স্বাগত বক্তব্য দিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি যুক্তিবাদী সমাজ গড়ে তুলতে চাই। সে লক্ষ্য নিয়ে স্কুল থেকেই নতুন প্রজন্মকে যুক্তি ও সহিষ্ণুতার চর্চায় উৎসাহিত করতে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।’
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করে শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, বিতর্কে যুক্তি থাকবে, যুক্তি খণ্ডন করার পাল্টা যুক্তিও থাকবে। বিতার্কিকদের যথাযথ যুক্তির জন্য সমাজের প্রতি নজর রাখতে হবে। চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা জানতে হবে। বিচক্ষণ মানুষ হওয়ার জন্য বিতর্কের প্রয়োজন রয়েছে।
পুষ্টির গ্রুপ পরিচালক মোস্তফা হায়দার বলেন, তাঁদের গ্রুপ এই আয়োজনে অংশ নিতে পারায় তাঁরা আনন্দিত। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বিতর্ক আরও জনপ্রিয় করে তুলতে এই আয়োজন অব্যাহত রাখতে তাঁরা সহায়তা দিয়ে যাবেন।
উপাচার্য ড. রুবানা হক নবীন বিতার্কিকদের বলেন, বিতর্কের এই যুক্তির যুদ্ধে কেউ জয়ী হবে কেউ হারবে। কিন্তু পরস্পরের প্রতি সহমত না হলেও তোমরা অনেক নতুন বন্ধু খুঁজে পাবে। তাদের সঙ্গে সহাবস্থান গড়ে তুলতে পারবে। বিতর্ক সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেবে।
অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও পেরেরা শিক্ষার্থীদের বলেন, কেবল পাঠ্যপুস্তকের পড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বিতর্ক থেকে তারা জীবনভিত্তিক শিক্ষা লাভ করতে পারবে। যৌক্তিকভাবে কথা বলতে শিখবে। এটা পরবর্তী জীবনে তাদের ভালো মানুষ ও যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠতে সহায়তা করবে।
আলোচনা পর্বের পরে মনোচিকিৎসক মোহিত কামাল শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বৃদ্ধি, সঠিকভাবে মেধার চর্চা, প্রতিভার বিকাশ নিয়ে পরামর্শমূলক আলোচনা করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের মাদক পরিহার করতে উদ্বুদ্ধ করে মাদকের প্রতি না বলার অঙ্গীকার করান।
গানে গানে শেষ হয়েছিল উদ্বোধনী এই পর্ব। শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী শোনালেন দেশের গান ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’। তিনি ‘বকুল ফুল বকুল ফুল’ গানটিও গেয়ে শোনান। শিল্পী মাহতিম সাকিব গেয়েছেন ‘বকুলের মালা শুকাবে’ এবং ‘ফাগুন হাওয়া হাওয়ায়’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’-সহ কয়েকটি গানের অন্তরা নিয়ে একটি মেলোডি গান করেন তিনি। সঞ্চালনা করেন বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক ও মহানগরের উপদেষ্টা ফাল্গুনী মজুমদার।
স্কুলে শ্রেণিকক্ষগুলোয় এখন চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা। আর অভিভাবকেরা কেউ মঞ্চে সামনের আসনে বা মাঠের মিঠে রোদে বসে অন্যদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন হয়েছেন। এক সারি স্টল বসানো হয়েছে মঞ্চের পাশেই। সেখানে আছে প্রথমা প্রকাশন, বিজ্ঞানচিন্তা, কিশোর আলো ও পুষ্টির স্টল। স্টল থেকে কেনাকাটাও করছেন অনেকে।