বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে কয়েক দফা হামলা, ব্যাংক ও অস্ত্র লুটের ঘটনার চার দিন পর সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সমন্বিত অভিযান শুরু হয়েছে। রোববার ভোরে কুকি–চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) এক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সমন্বিত অভিযানের কার্যক্রম পরিদর্শনে গতকাল রোববার সকালে বান্দরবান আসেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বান্দরবান সেনা রিজিয়ন ও ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সমন্বিত অভিযান শুরু হয়েছে। সন্ত্রাসীরা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলমান থাকবে।
এর আগে গত রোববার ভোরে বান্দরবান জেলা শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে শ্যারণপাড়ায় র্যাব অভিযান চালায়। সেখান থেকে চেওসিম বম (৫৫) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাব বলছে, চেওসিম বম কেএনএফের বান্দরবান সদর উপজেলা ও রোয়াংছড়ির কিছু অংশ নিয়ে গঠিত সদর ডিভিশনের প্রধান সমন্বয়কারী। তিনি কেএনএফের প্রধান নাথান বমের ঘনিষ্ঠদের একজন।
এ বিষয়ে গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানান র্যাব ১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, অভিযানে সেনাবাহিনী র্যাবকে সহযোগিতা করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব অভিযান চালিয়ে চেওসিম বমকে গ্রেপ্তার করে। প্রায় আধঘণ্টা তল্লাশি চালিয়ে বাড়ির ভেতরে কুঠুরির মতো অন্ধকার এক কোনায় লুকিয়ে থাকা অবস্থায় চেওসিম বমকে পাওয়া যায়। ওই বাড়ি থেকে দুটি এয়ারগান উদ্ধার করা হয়েছে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ গতকাল বান্দরবান সেনা রিজিয়ন পরিদর্শন শেষে দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন।
অভিযানের সবকিছু সমন্বয় করতে বান্দরবান রিজিয়ন সদর দপ্তরে এসেছেন জানিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটি সরকারের সমন্বিত কৌশলের ভেতরে মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। বিজিবি, র্যাব, আনসার ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসনও দায়িত্ব পালন করবে। কারণ, এটি একক কোনো কাজ নয়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা খুবই পরিষ্কার। জনগণের শান্তি ও দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য যা করার প্রয়োজন, তা করতে হবে।
সেনাপ্রধান বলেন, আগের অভিযানে কেএনএফকে সব ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে শান্তি আলোচনার ছত্রচ্ছায়ায় তারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এখন সরকারের সামগ্রিক কৌশল অনুযায়ী সমন্বিত অভিযানে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, শান্তি আলোচনা নিয়ে তাদের (কেএনএফ) বিশ্বাস করা হয়েছিল। গত ৩১ মার্চ ইস্টার সানডে উপলক্ষে সেনাবাহিনীর রুমা জোন থেকে ৩৮টি কেক বিভিন্ন গির্জায় পাঠানো হয়েছিল। বেথেলপাড়ার সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কেক উপহার দেওয়া হয়। আর কেক বিতরণের এক দিন পর ২ এপ্রিল রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
গত মঙ্গলবার রাতে ও পরদিন বুধবার দুপুরে বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা টাকা লুট করে ও একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে ওই ব্যাংক কর্মকর্তাকে উদ্ধার করা হয়। সন্ত্রাসীরা পুলিশ ও আনসারের ১৪টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনায় কেএনএফ জড়িত বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হামলার পর গত বুধবার থেকে রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় ব্যাংক লেনদেন বন্ধ রয়েছে।
হামলার পর গত শনিবার বান্দরবানে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এদিকে কেএনএফের সদস্যদের অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’।
এর আগে দুই দফা বৈঠকে সই করা সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে গতকাল বিবৃতি দিয়েছেন শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা মারমা এবং সদস্যসচিব ও বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজার লম বম।
বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, কেএনএফ চুক্তি ভঙ্গ করলেও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে ৯৬৮টি বম পরিবারের মধ্যে ১৩৪ টন চাল, ডাল, নগদ টাকা ও শীতবস্ত্র প্রদান করা হয়েছে। কারাগার থেকে দুজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আরও দুজনের মুক্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাদের দাবিগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গোচরীভূত করা হয়েছে।
বিবৃতিতে সব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিহার ও সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী অস্ত্র সমর্পণ করে কেএনএফ সদস্যদের অবিলম্বে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।