নওগাঁর মান্দা উপজেলায় অবস্থিত কুসুম্বা মসজিদ। মসজিদের পূর্ব দিকে কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারের শিলালিপি অনুসারে এ মসজিদের নির্মাণকাল ৯৬৬ হিজরি (১৫৫৮-৫৯ খ্রিষ্টাব্দ)
ইটপাথরে নির্মিত মসজিদটি স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। দেয়ালজুড়ে আছে প্রাচীন টেরাকোটার কাজ। আছে জ্যামিতিক নকশার আদলে পোড়ামাটির সুদৃশ্য কারুকাজ। মিহরাবে বিচিত্র ফুল, লতাপাতা, ঝুলন্ত শিকল ও মনোরম শিল্পকর্ম। প্রায় ৪৬৪ বছরের পুরোনো এই মসজিদ স্থাপত্য নান্দনিকতায় আজও মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী কৃষিনির্ভরশীল জেলা নওগাঁয় এই মসজিদের অবস্থান, নাম ‘কুসুম্বা মসজিদ’। স্থাপত্যশৈলী ও নন্দনতাত্ত্বিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে দেশের ৫ টাকার নোটে কুসুম্বা মসজিদের ছবি ছাপানো হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, বাংলায় আফগানদের শাসনামলে শূর বংশের শেষ দিকের শাসক গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহর রাজত্বকালে জনৈক সুলায়মান মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি সম্ভবত একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। পূর্ব দিকের কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারের ওপরে স্থাপিত আরবিতে (শুধু নির্মাতা শব্দটি ফারসিতে) উৎকীর্ণ শিলালিপি অনুসারে এ মসজিদের নির্মাণকাল ৯৬৬ হিজরি (১৫৫৮-৫৯ খ্রিষ্টাব্দ)। মসজিদটি শূর আমলে নির্মিত হলেও এ মসজিদে উত্তর ভারতে ইতিপূর্বে বিকশিত শূর স্থাপত্যের প্রভাব মোটেই দেখা যায় না, বরং এটি বাংলার স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। ইটের গাঁথুনি, সামান্য বক্র কার্নিশ এবং সংলগ্ন অষ্টকোনাকৃতির পার্শ্ববুরুজ প্রভৃতি এ রীতিকে সমর্থন করে।
কুসুম্বা মসজিদ রাজশাহী থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কে মান্দা উপজেলার কুসুম্বা মোড় এলাকা থেকে ৪০০ মিটার পশ্চিমে এগোলে কুসুম্বা গ্রাম। এখানে মসজিদটির অবস্থান। গ্রামটির নামকরণ নিয়ে নানারকম জনশ্রুতি আছে। এর একটি হলো, গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর বেগম কুসুম বিবি বিশেষ কারণে এ অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁর নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ হয় কুসুম্বা। পরে কুসুম বিবির নামানুসারে মসজিদ নির্মিত হয়। তবে এর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই বলে মনে করেন ইতিহাসবিদেরা।
কুসুম্বা মসজিদটি চারকোনাবিশিষ্ট। কালো ও ধূসর রঙের পাথর আর পোড়ামাটির ইটে গড়া এই মসজিদ। ব্যবহার করা হয়েছে মাটির টালি। ইটের তৈরি দেয়ালের বাইরে ও ভেতরের দিক পাথরে আবৃত। মসজিদের চার কোনায় চারটি আটকোনাকৃতির বুরুজ (মিনার) আছে। এর ভেতরে রয়েছে দুটি প্রশস্ত স্তম্ভ।
বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, মসজিদের মিহরাবগুলো খোদাই করা পাথরের নকশা দিয়ে অলংকৃত। এগুলোতে রয়েছে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান। সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত পাথরের তৈরি স্তম্ভের ওপর স্থাপিত এ খিলানগুলোর শীর্ষে রয়েছে কলস মোটিফের অলংকরণ।
কুসুম্বা মসজিদ ৫৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫২ ফুট প্রস্থ। এর উচ্চতা ৪২ ফুট। চারদিকের দেয়াল ছয় ফুট পুরু। মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে তিনটি দরজা। আকারে দুটি বড়, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট
স্তম্ভগুলোর গায়ে রয়েছে ঝুলন্ত শিকল ঘণ্টার নকশা। মিহরাবের ফ্রেমে রয়েছে প্রায় সর্পিল আকারে খোদিত আঙুরগুচ্ছ ও লতার নকশা। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় বিন্দুর আকার ধারণকারী কলস, বৃক্ষলতা ও গোলাপ নকশা। প্ল্যাটফর্মের প্রান্তেও রয়েছে আঙুর লতার অলংকরণ। মসজিদের কিবলা দেয়ালজুড়ে রয়েছে গোলাপ নকশা।
কুসুম্বা মসজিদ ৫৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫২ ফুট প্রস্থ। এর উচ্চতা ৪২ ফুট। চারদিকের দেয়াল ছয় ফুট পুরু। মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে তিনটি দরজা। আকারে দুটি বড়, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট। ছাদের ওপর রয়েছে মোট ছয়টি গম্বুজ, যা দুটি সারিতে নির্মিত।
মসজিদ–সংলগ্ন ৭৭ বিঘা আয়তনের একটি বিশাল দিঘি রয়েছে। দিঘিটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২০০ ফুট (৪০০ মিটার) ও প্রস্থে ৯০০ ফুট (৩০০ মিটার)। গ্রামবাসী ও মুসল্লিদের খাওয়ার পানি, গোসল ও অজুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য দিঘিটি খনন করা হয়েছিল।
সংরক্ষিত ঐতিহাসিক স্থাপনাটি দেখভাল করে থাকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। ১৫ বছর ধরে স্থানীয় বাসিন্দা ইমাম আলী মসজিদের মূল খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মসজিদটি বাংলার স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। ইটের গাঁথুনি, সামান্য বক্র কার্নিশ এবং সংলগ্ন অষ্টকোনাকৃতির পার্শ্ববুরুজ প্রভৃতি এ রীতিকে সমর্থন করে।
কুসুম্বা মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য ইমামের দায়িত্বে আছেন ওবায়দুল হোসেন, আর শুক্রবার জুমার নামাজের ইমামতির দায়িত্ব পালন করছেন মোস্তফা আলী। সম্প্রতি কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এ মসজিদের তিনটি গম্বুজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এরশাদ সরকারের আমলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ গম্বুজগুলো সংস্কার করে। তারও পরে মসজিদের সামনের অংশ থেকে দিঘি পর্যন্ত পাকা করা হয়। মসজিদের সামনের খোলা স্থানটিতে নামাজ আদায় করা যায়। মসজিদের পেছনের দিকে একটি হিফজখানা, মক্তব এবং লিল্লাহ বোর্ডিং রয়েছে। সরকারি অনুদান ও এলাকাবাসীর দানে এগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
ওবায়দুল হোসেন ও মোস্তফা আলী আরও জানান, মসজিদের ভেতরে চারটি কাতারে প্রায় ৮০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এ ছাড়া মসজিদের সামনের অংশে খোলা স্থানে প্রায় ৭০০ মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন। প্রতি শুক্রবার ও বছরে দুই ঈদের জামাতে মসজিদের ভেতর ও বাইরের পুরো চত্বর মুসল্লিতে ভরে যায়। এ ছাড়া পবিত্র রমজানে তারাবিহর নামাজও পড়া হয় এখানে।