পৌনে পাঁচ কোটি তরুণের দেশ, কর্মক্ষম মানুষ ৬২ শতাংশ

দেশে চূড়ান্ত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন, যার মধ্যে ২৮ শতাংশ তরুণ। আর ৬২ শতাংশ মানুষই কর্মক্ষম। 

তারুণ্যের জয়গান চলছে দেশে। মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের ১ ভাগ এখন তরুণ, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। সংখ্যায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ। জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তারুণ্যের পাশাপাশি দেশে কর্মক্ষম মানুষের পাল্লাও ভারী। মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। সংখ্যায় যা ১০ কোটি ৫০ লাখ। পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গতকাল রোববার সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার প্রতিবেদন তুলে ধরেন জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের পরিচালক দিলদার হোসেন। এ সময় আরও বক্তব্য দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব শাহনাজ আরেফিন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, বিবিএসের মহাপরিচালক মতিয়ার রহমান প্রমুখ।

তরুণদের সংখ্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারের চাহিদা মাথায় রেখে তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। কেননা, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতির এ সুবিধা বেশি দিন থাকে না।

এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান বাজারব্যবস্থা সামনে রেখে দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছে। এতে অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সামনে রেখে তারুণ্যকে চাকরির বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বয়সভিত্তিক বিভাজন

তারুণ্যের বয়স বিভাজন নিয়ে জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মোট জনগোষ্ঠী এখন ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীর হার ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীর হার ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের তরুণ হিসেবে ধরা হয় দেশে। সে হিসেবে তারুণ্যের হার ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ, সংখ্যায় যা পৌনে পাঁচ কোটি।

তরুণ জনগোষ্ঠী নিয়ে সরকারের ভাবনা কী, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গতকাল সন্ধ্যায় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এখন পর্যন্ত যতগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে, সবগুলোতে তরুণদের সামনে রাখা হয়েছে। সরকারের মূল লক্ষ্য তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। তার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। দেশে দারিদ্র্যের হার কমে আসছে বলে জানান তিনি।

বিবিএস জানিয়েছে, দেশে প্রবীণ বা ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক কম। মোট জনগোষ্ঠীর ১ কোটি ৯৮ লাখ মানুষ ষাটোর্ধ্ব। এ হার ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

চূড়ান্ত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার

জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে এখন জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৪০ লাখ ৭৭ হাজার ২০৩ জন। মোট জনগোষ্ঠীর ৪৯ দশমিক ৫১ শতাংশ পুরুষ। নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৩ হাজার ১২০ জন, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৫০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ পুরুষের তুলনায় নারী ১৫ লাখ ৭৫ হাজার ৯১৭ বেশি।

ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার হিসাবে দেখা যায়, দেশে এখন মুসলমান জনসংখ্যা ১৫ কোটি ৪৫ লাখ ৪২ হাজার ৭৮ জন, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৯১ শতাংশ। অন্য ধর্মাবলম্বীর হার ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

শুমারির তথ্য আরও বলছে, গ্রামে বসবাস করছে ১১ কোটি ৬১ লাখ মানুষ, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। শহরে বসবাস করছে ৫ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ বা ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

বিভাগভিত্তিক বিভাজন

বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশে এখন সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে ঢাকা বিভাগে—৪ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৫ জন, যা মোট জনগোষ্ঠীর ২৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম বিভাগে বাস করে ৩ কোটি ৪১ লাখ, যা মোট জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ। এরপরই আছে রাজশাহী বিভাগ—১২ দশমিক ২৪ শতাংশ। সবচেয়ে কম মানুষের বসবাস বরিশাল বিভাগে—মাত্র ৯৩ লাখ ২৫ হাজার, যা মোট জনগোষ্ঠীর সাড়ে ৫ শতাংশ।

বিভাগভিত্তিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য বিশ্লেষণ করে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন অনুষ্ঠানে বলেন, আগের দশকে দেশে নগরায়ণ বেড়েছে ১ শতাংশ হারে। কিন্তু এই দশকে নগরায়ণ হয়েছে দশমিক ৪ শতাংশ হারে। সাধারণত দেশ উন্নত হলে নগরায়ণ বাড়ে। এই দশকে নগরায়ণের গতি কমেছে। এই গতি কেন কমল, তা খুঁজে বের করতে নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ প্রয়োজন।

প্রবাসীর সংখ্যা জানা গেল না

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কত সংখ্যায় প্রবাসী বসবাস করে, তার সঠিক কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। এবারের জনশুমারিতে তা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিবিএস। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে অন্য সব তথ্য দিলেও এই তথ্য দেয়নি সংস্থাটি।

প্রবাসীর সংখ্যা কত, সে তথ্য প্রকাশে কোনো বাধা আছে কি না, প্রথম আলোর পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন জানান, জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত আছে। ওই সময়ের মধ্যে বিদেশে অবস্থানকারী প্রবাসীদের তথ্য দেওয়া হবে। এ তথ্য প্রকাশে কোনো বাধা নেই।

যদিও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কতসংখ্যক প্রবাসী বসবাস করছেন, তা জানতে সবার আগ্রহ আছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা যেত। এটা তেমন কঠিন ছিল না। এর আগে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের সময়ও দেওয়ার কথা ছিল। তবে তিনি বিবিএসের ওপর আস্থা রাখার পরামর্শ দেন।

আর জনশুমারি চান না দুই মন্ত্রী

আলোচনায় অংশ নিয়ে দুই মন্ত্রী জানিয়েছেন, বর্তমান পদ্ধতিতে তাঁরা আর জনশুমারি চান না। দেশের জনসংখ্যা কত, তা জানার জন্য ১০ বছর অপেক্ষা করার পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে মত দেন পরিকল্পনামন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের যন্ত্র আছে; জ্ঞান আছে, জনবল আছে। সরকারি কর্মকর্তা আছে। তাহলে কেন জনসংখ্যার তথ্য জানার জন্য ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। জনশুমারির পেছনে কেন দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্কের মতো দেশগুলো কীভাবে জনসংখ্যার হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে, তা পর্যালোচনা করতে বিবিএসকে নির্দেশ দেন তিনি। প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়ার কথাও বলেন।

একই সুরে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, নেদারল্যান্ডস এক বছরের মধ্যে জনসংখ্যার তথ্য প্রকাশ করে। ইউরোপের দেশগুলোতেও তা–ই হচ্ছে। আমাদের দেশেও এক বছরের মধ্যে জনশুমারির তথ্য প্রকাশ করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার তাগিদ দেন তিনি।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১৫ থেকে ২১ জুন দেশজুড়ে জনশুমারি পরিচালনা করে বিবিএস। তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। বিবিএসের শুমারিতে কতসংখ্যক বাদ পড়েছে, তা জানতে আলাদাভাবে জরিপ করে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করা প্রতিবেদনে বিআইডিএস জানায়, বিবিএসের শুমারিতে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষ বাদ পড়েছে। বিবিএস সেই অংশ যোগ করেই গতকাল দেশের জনসংখ্যার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে।