চতুর্থ দফার অবরোধ

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি বাসে আগুন

অবরোধের সমর্থনে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ব্যানারে মিছিল বের করা হয়। মিছিল শেষে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। গতকাল দুপুরে সিলেটের শাহি ঈদগাহ এলাকায়
ছবি: আনিস মাহমুদ

কখনো ভোরে, কখনোবা দুপুরে, আবার কখনো রাতে—বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা কিছুতেই থামছে না। বিএনপির ডাকা চতুর্থ দফার অবরোধের প্রথম দিনে সারা দেশে এমন ঘটনা অন্তত পাঁচটি। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই গতকাল রোববার তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।

রাজধানীর সূত্রাপুরে বাসে আগুন দেওয়া হয় ভোরে। দুপুরে মিরপুরে আরেকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। আর রাতে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি ঘটে তেজগাঁও এলাকায়।

অবরোধের সমর্থনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করেছেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দল এবং জোটের পক্ষ থেকেও মিছিল–সমাবেশ হয়েছে। সিলেট ও বগুড়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা সড়ক অবরোধ করেছেন। সংখ্যায় কিছুটা কম হলেও গতকালের অবরোধেও ঢাকায় গণপরিবহন চলেছে। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি চলেছে কম। আর ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে দূরপাল্লার বাস চলাচল কার্যত বন্ধ ছিল। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। যাত্রীর অভাবে লঞ্চ স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম চলেছে।

এর আগের তিন দফার অবরোধের এবারের অবরোধেও দেশজুড়ে বিভিন্ন সড়কে পুলিশ–র‌্যাব ও বিজিবির টহল ছিল। পাশাপাশি অবরোধে নাশকতা ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মিছিল–সমাবেশ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দলটির নেতা-কর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে। কোথাও রাস্তার পাশে–ফুটপাতে চেয়ার পেতে বসে তাঁরা আড্ডা দিয়েছেন। কখনো স্লোগান দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মঞ্চ বানিয়ে গান গেয়েছেন শিল্পীরা।

অবরোধের মধ্যে গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়। যখন বাসটিতে আগুন দেওয়া হয়, তখন ঘটনাস্থলের কাছেই চলছিল আওয়ামী লীগের ‘শান্তি সমাবেশ’। সড়কের ঠিক যেখানে বাসে আগুন দেওয়া হয়, তার ১০০ গজের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের একটি কার্যালয়। সেখানে পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ওই এলাকায় পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভের কারণে পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তাও ছিল। এর মধ্যেই বাসে আগুন দিয়ে চলে যায় দুর্বৃত্তরা।

বাসে আগুন দেওয়ার সময় ‘শান্তি সমাবেশে’ বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক উইলিয়াম প্রলয় সমাদ্দার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বক্তব্য দেওয়ার সময় হঠাৎ দেখেন বাসে আগুন জ্বলে উঠছে।

প্রজাপতি পরিবহনের যে বাসে আগুন দেওয়া হয়, তাতে প্রায় ৪০ জন যাত্রী ছিলেন। যাত্রীবেশে বাসে উঠে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে বলে জানান মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর বাসের যাত্রীরা দ্রুত বাস থেকে নেমে যান। অগ্নিসংযোগকারীকে শনাক্ত করা যায়নি।

তবে বাসে আগুন দেওয়ার পেছনে সরকারের লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একাধিকবার ভার্চ্যুয়াল ব্রিফিংয়ে এমন দাবি করেছেন।

এদিকে গতকাল ভোরে ঢাকার সূত্রাপুরে আরেকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া গতকাল রাত সোয়া আটটার দিকে তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো এলাকাতেও বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় মোট ৭৪টি যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল।

পুলিশের নানা ধরনের তৎপরতার মধ্যেও ঢাকায় একের পর এক বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে গোয়েন্দা দুর্বলতা রয়েছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ বলেন, যারা বাসে আগুন দিচ্ছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নাশকতাকারীদের অনেকের নাম জানা গেছে।

নারায়ণগঞ্জে দুটি বাসে আগুন

গতকাল ভোরে ও সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে দুটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয় সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে। তবে দুটি বাসে আগুনে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে ২ নম্বর ঢাকেশ্বরী এলাকায় রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা একটি মিনিবাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যেখানে বাসে আগুন দেওয়া হয়, সেখানে শত শত লোকের আনাগোনা আছে। এটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এর আগে গত শনিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়ায় লাব্বাইক পরিবহনের একটি বাস ভাঙচুর করা হয়।

সব মিলিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৯৫টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলার প্রথম আলোর প্রতিনিধি, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

গতকাল সকাল থেকে গাবতলী বাস টার্মিনালে যাওয়া যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। টার্মিনালে বাস থাকলেও ছাড়বে কি না, তার নিশ্চয়তাও পরিবহনশ্রমিকেরা দিতে পারছিলেন না। বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির কাউন্টারের কর্মীরা বলেছেন, পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় বাস ছাড়া হচ্ছে না।

টার্মিনালে কথা হয় যাত্রী রিমন হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর বাড়ি জয়পুরহাটে। অসুস্থ বাবাকে দেখতে তাঁর বাড়ি যাওয়া দরকার। সকাল আটটার দিকে গাবতলী এসেছেন। কিন্তু দুই ঘণ্টা পরও কোনো বাস পাননি।

ঢাকার বাইরে অবরোধের সমর্থনে গতকাল বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় ও সিলেটের দ‌ক্ষিণ সুরমা এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা। এ ছাড়া গত শনিবার রাতে অবরোধ শুরু হওয়ার আগে নাটোর রেলস্টেশন এলাকায় দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটানো হয়।

বাসের যাত্রীদের ছবি তুলে রাখতে নির্দেশনা

অবরোধ কর্মসূচিতে অগ্নিসন্ত্রাস প্রতিরোধে বাসের যাত্রীদের ছবি তুলে রাখাসহ ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের জন্য দেওয়া এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে নির্ধারিত স্থান ছাড়া (স্টপেজ) কোনো যাত্রী বাসে উঠতে বা নামতে পারবে না; বিভিন্ন স্টপেজে যাত্রীদের এবং বাসের ছবি তুলে রাখা, বাসের দুটো দরজা থাকলে পেছনের দরজা অবশ্যই বন্ধ রাখা, রাতে বিচ্ছিন্নভাবে বাস পার্কিং না করা, কোনো উন্মুক্ত স্থানে একাধিক বাস রাখলে নিজস্ব নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা, রাতে বাসের ভেতরে পরিবহনশ্রমিকদের কেউ যাতে না ঘুমায়, বাসে সচেতনতামূলক স্টিকার লাগোনো।

ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নাশকতা ঠেকাতে পুলিশ কাজ করছে। নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি নাশকতা মোকাবিলায় পরিবহনমালিক–শ্রমিকদের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে সবাই মিলে নাশকতাকারীদের রুখে দেওয়া যায়।