সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, সংঘাত, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত ১১ দিনে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা দেশের ৫৬টি মহানগর ও জেলার পুলিশ সূত্র থেকে গত ১১ দিনের (১৭-২৭ জুলাই) মোট গ্রেপ্তারের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি জেলায় কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু জেলায় গ্রেপ্তারের আরও তথ্য জানা গেছে। সব মিলিয়ে গতকাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৯ হাজার ১২১ জন। এর আগে গত শুক্রবার পর্যন্ত সারা দেশে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি গ্রেপ্তারের তথ্য ছিল।
কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি শুরু করেন ১ জুলাই। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সারা দেশে। এর পরদিন থেকে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন জায়গায় এসব ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। এখনো বিভিন্ন জায়গায় মামলা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবং দল দুটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
গতকাল মেট্রোরেলে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন আদালত। এ ছাড়া রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে আগুন ও ভাঙচুরের মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিসহ তিনজনের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন, এখন পর্যন্ত তাঁদের দলের ৩৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা ও অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকার সৃষ্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হত্যা-নির্যাতনের পর এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে সাজানো মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিরোধী মতের নেতাদের হত্যা, গ্রেপ্তার, গুলি করে আদালতে ওঠানোর আগেই নির্যাতন করে পঙ্গু করা হচ্ছে এবং বিচার বিভাগকে দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে আবারও নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেশি ঘটেছে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে। রাজধানীর উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, আজিমপুর, নীলক্ষেতসহ প্রায় পুরো রাজধানীতে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনার পর মামলা ও গ্রেপ্তারও বেশি হচ্ছে রাজধানী ও এর চারপাশে।
২১ জুলাই রাত থেকে রাজধানীতে চিরুনি অভিযান শুরু করে পুলিশ ও র্যাব। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্রেপ্তার অভিযানে ‘ব্লক রেইড’ দেওয়া হচ্ছে। সহিংসতায় কারা জড়িত ছিলেন, তা বের করতে ভিডিও ফুটেজ ও ছবি বিশ্লেষণ করে তালিকাও করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গতকাল বিকেলে জানায়, গতকাল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মোট ২০৭টি মামলা হয়েছে। মোট ২ হাজার ৫৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৫২ জন।
অন্যদিকে র্যাব জানিয়েছে, নাশকতার অভিযোগে সাম্প্রতিক সময়ে তারা ২৯০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৭১ জন ও ঢাকার বাইরে ২১৯ জন।
ঢাকা মহানগরের বাইরে ঢাকা জেলার সাভার, ধামরাই, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ ও দোহারেও চলছে গ্রেপ্তার অভিযান। জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরের বাইরে ঢাকা জেলায় গতকাল নতুন করে আরও ৪টি মামলা হয়েছে। এ নিয়ে ঢাকা জেলার বিভিন্ন থানায় মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪। এসব মামলায় গতকাল পর্যন্ত ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরেও আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। সেখানেও গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত আছে। নারায়ণগঞ্জে শুক্রবার রাত থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত আরও ৫১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেখানে গতকাল আরও ২টি মামলা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে ২৪টি মামলা হয়েছে। মোট গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৮৭ জনকে।
গাজীপুরেও গতকাল আরেকটি নতুন মামলা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত গাজীপুরে মামলা হয়েছে ৩৭টি। মোট গ্রেপ্তার ৩৯৬ জন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ ও নিহতের ঘটনায় চট্টগ্রাম মহানগরীতে গতকাল নতুন আরও একটি মামলা হয়েছে। গতকাল আকবরশাহ থানায় এই মামলা হয়। গতকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা মিলিয়ে মোট মামলা হয়েছে ৩০টি। গতকাল পর্যন্ত এসব মামলায় ৮৮৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, বগুড়া ও রংপুরে মামলা এবং গ্রেপ্তার তুলনামূলক বেশি। রংপুরে গতকাল পর্যন্ত মোট ১২টি মামলায় ১৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজশাহীতে গতকাল পর্যন্ত মোট ১৭টি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৪৫ জনকে। আর বগুড়ায় মোট ১৫টি মামলায় গতকাল পর্যন্ত ২৯৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নাশকতার বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার ১৭২ জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার সিএমএম আদালত গতকাল এ আদেশ দেন।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা আদালতের সামনে ভিড় করেন। কয়েকজন আসামির আইনজীবীরা দাবি করছেন, হয়রানির উদ্দেশ্যে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়।
চকবাজার থানার মামলায় আলামিন নামের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। ছেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য মা মাকছুদা খাতুন আদালতে আসেন দুপুর ১২টার দিকে। বিকেল ৪টার সময়ও ছেলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। মাকছুদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, নিউমার্কেট থেকে বাসায় ফেরার পথে পুলিশ তাঁর ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁর মুঠোফোনে আন্দোলনের ভিডিও দেখে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মাকছুদা খাতুনের দাবি, তাঁর ছেলে আন্দোলনে ছিল না।
আদাবর থানার নাশকতার মামলায় শেখ রেদোয়ান ও তাঁর বাবা শেখ জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে গতকাল আদালতে হাজির করা হয়। সন্তানকে দেখার জন্য দুপুর ১২টার দিকে আদালতে আসেন সুমাইয়া খাতুন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা থাকেন মোহাম্মদপুরে। মধ্যরাতে গিয়ে তাঁর স্বামী ও ছেলেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নাশকতার কোনো ঘটনার সঙ্গে তাঁর ছেলে ও স্বামী জড়িত নন বলে দাবি করেন সুমাইয়া খাতুন।