গরু বেচতে হলে ইউপি চেয়ারম্যানের অনুমতি নিতে হয়। বাস্তবে বিক্রির অনুমতি পায় চোরাকারবারিদের গরু।
দহগ্রামের বাসিন্দা ছাত্তার আলী চার মাস ধরে তাঁর পালিত গরুটি বিক্রি করতে চেয়েও পারছেন না। কারণ, গরু বিক্রি করতে দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে অনুমতিপত্রের (স্লিপ) প্রয়োজন হয়, তা তিনি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় ভারত সীমানাবেষ্টিত ২২ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দহগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা প্রায় ২০ হাজার। অধিকাংশ পরিবার কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের একমাত্র পথ তিনবিঘা করিডর ফটক (গেট)।
মূলত দহগ্রাম ইউনিয়নে গরু বিক্রি করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনুমতিপত্র নিতে হয় কৃষকদের। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কাগজে–কলমে এসব গরু কৃষকের দেখানো হলেও বাস্তবে চোরাকারবারিদের গরু বিক্রির জন্য অনুমোদন পায়। এ কারণে দহগ্রামের প্রকৃত কৃষকেরা গরু বিক্রির অনুমতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
দহগ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আর্থিক সংকটে পড়ে দেড় মাস মেম্বার–চেয়ারম্যানের কাছে স্লিপের জন্য ঘুরেছেন। কিন্তু তা না পাওয়ায় সেই গরু জবাই করে গোশত বিক্রি করতে হয়েছে। হাঁড়িপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নবাব আলীও একই অভিযোগ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ১৯৯২ সালের ২৬ জুন দহগ্রাম–আঙ্গরপোতার করিডর গেট খুলে দেওয়ার পর স্থানীয় কৃষকেরা গরু এনে পাটগ্রাম বাজারে বিক্রি করতেন। কিন্তু একসময় অবাধে গরু আনা বন্ধ করে দেয় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
এরপর দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে প্রতি সপ্তাহে ২০টি গরু করিডর গেট দিয়ে দেশের মূল ভূখণ্ডে পাঠানার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১১ সাল থেকে দহগ্রাম ইউনিয়ন থেকে প্রতি শনিবার ও বুধবার ৩০টি করে মোট ৬০টি গরু তিনবিঘা করিডর গেট দিয়ে কৃষকেরা বিক্রি করতে নিয়ে আসছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দহগ্রাম ইউনিয়নে ৪০ থেকে ৪৫ জনের অবৈধ গরু চোরাকারবারির চক্র গড়ে উঠেছে। এই চোরাকারবারিরা ভারতীয় গরু এনে ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে পাটগ্রামের রসুলগঞ্জ পৌর পশুর হাটে বিক্রি করেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, প্রতি হাটে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যে ৩০টি গরু বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়, তার ৪টির ভাগ পান ইউপি চেয়ারম্যান। বাকি ২৬টির ভাগ নেন ইউপি সদস্যরা। স্থানীয় বাসিন্দা ও চোরাকারবারিদের ভাষ্যমতে, চাহিদা অনুযায়ী একটি স্লিপের মূল্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে দহগ্রামে ইউনিয়ন পরিষদে প্রতি সপ্তাহে প্রায় দেড় কোটি টাকার স্লিপ–বাণিজ্য হচ্ছে।
দহগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান অবশ্য স্লিপ–বাণিজ্যের অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। তাঁর দাবি, ইউনিয়ন পরিষদ প্রতিটি স্লিপের জন্য নির্ধারিত ১২০ টাকা নেয়। এর বাইরে কোনো টাকা নেন না। দহগ্রাম ইউপির কয়েকজন সদস্যও একই দাবি করেন।
তবে দহগ্রামের কাতিপাড়ার গরু ব্যবসায়ী দারাজ আলী টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, গত বুধবারও (২৩ নভেম্বর) তিনি ভারতীয় তিনটি গরু বৈধ করতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হানিফ আলীর মাধ্যমে তিনটি স্লিপ নিয়েছেন। এ জন্য গরুপ্রতি ৩৫ হাজার করে মোট ১ লাখ ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফুলবানু বলেন, ‘চেয়ারম্যান-মেম্বারের পেছনে স্লিপের জন্য অনেক ঘুরেও পাইনি। বাধ্য হয়ে ২০ হাজার টাকা দিয়ে স্লিপ কিনে তারপর হাটে গরু বিক্রি করেছি।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দহগ্রাম–আঙ্গরপোতায় ভারতের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই। ফলে সীমান্তের ওপার থেকে ব্যবসায়ীদের হয়ে রাখালেরা সুযোগ বুঝে (স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ডাংগোয়াল) গরু আনেন। সেগুলো চোরাকারবারিসহ কৃষকদের বাড়িতে রাখা হয়।
গত ২২ ও ২৩ নভেম্বর দহগ্রামের কাতিপাড়ার কবির হোসেন, সাইব আলী ও দহগ্রামের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের বাড়িতে গেলে বেশ কিছু ভারতীয় গরু দেখা যায়। কবির হোসেন স্বীকার করেন, তাঁরা চারজন মিলে গরুর ব্যবসা করছেন।
তিনজন চোরাকারবারির দেওয়া তথ্যমতে, অবৈধ গরু দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে তিন বিঘা করিডোর পার করতে প্রতি গরুতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। এরপর পাটগ্রামে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করলে গরুপ্রতি তাঁদের ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়।
স্থানীয় মানুষজন ও বিজিবির সূত্র জানায়, দহগ্রামে গরু লালন–পালন করা কৃষকের নাম, গরুর সংখ্যা, রং, চিহ্নসহ আলাদা করে হিসাব বই আছে বিজিবির কাছে। তিনবিঘা করিডর দিয়ে গরু পারের সময় কৃষকের খাতা ও বিজিবির বই মিলিয়ে গরু পারের অনুমতি দেওয়া হয়।
এরপরও ভারতীয় গরু তিনবিঘা করিডর দিয়ে পার হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর ৫১ বিজিবির সহকারী পরিচালক (এডি) ওমর খসরু প্রথম আলোকে বলেন, হরিয়ানা ও মুন্ডি জাতের ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের গরু আলাদাভাবে চেনা সম্ভব নয়। তাই বেশির ভাগ সময় বিজিবিকে চেয়ারম্যানের স্লিপের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে তাঁর দাবি, অনেক সময় বিজিবির হিসাব বইয়ের সঙ্গে গরুর সংখ্যা ও বর্ণনা না মিললে সেগুলো ফেরত পাঠানো অথবা জব্দ করা হয়।
গত ২৩ নভেম্বর পাটগ্রাম ইউএনওর নেতৃত্বে দহগ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তিনবিঘা করিডর পারাপারের তালিকায় থাকা ১৪টি ভারতীয় গরু আটক করা হয়।
তবে পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা ও জেলা চোরাচালান নিরোধ টাস্কফোর্স কমিটির সভায় একাধিকবার বিষয়টি তোলা হয়েছিল। কিন্তু কোনোভাবেই গরু চোরাচালান থামছে না।