টিয়া পাখি উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া তাসফিয়ান ইসলাম আতিফ
টিয়া পাখি উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া তাসফিয়ান ইসলাম আতিফ

প্রাণী উদ্ধারে প্রশিক্ষণ নেই ‘রবিনহুডের’, তাসফিয়ানের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা শহরের বহুতল ভবনের কার্নিশ, বৈদ্যুতিক তারসহ বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়া পশু–পাখি উদ্ধারে কাজ করে রবিনহুড দ্য অ্যানিমেল রেসকিউয়ার। স্বেচ্ছাসেবী এ সংস্থার সদস্যরা ১৩ বছর ধরে এমন উদ্ধারকাজ চালিয়ে আসছেন। তবে এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আফজাল খানসহ উদ্ধারকর্মীদের এ কাজের প্রশিক্ষণ নেই।

কেরানীগঞ্জে বিদ্যুতের তারে আটকে পড়া টিয়া পাখি উদ্ধার করতে গিয়ে আফজাল খানের দেহরক্ষী তাসফিয়ান ইসলাম আতিফ (২০) দগ্ধ হন। গত বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত দুইটার দিকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর শরীরের ৮৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। ওই দুর্ঘটনায় আহত উদ্ধারকর্মী শফিকুর রহমান এখনো এখানে ভর্তি আছেন। আহত আরেক কর্মী বাড়ি ফিরেছেন।

তাসফিয়ানের মৃত্যুর পর দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তি কেন ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁর এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল কি না, উদ্ধারের আগে নিরাপত্তামূলক সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না—এসব প্রশ্ন সামনে এসেছে। প্রাণীপ্রেমী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন। তাসফিয়ানের বাবা নাজমুল ইসলাম মনে করছেন, তাঁর ছেলেকে ‘মার্ডার’ (হত্যা) করা হয়েছে। তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, মামলা করার কথাও ভাবছেন তিনি।

রবিনহুডের ফেসবুক পেজে টিয়া পাখি উদ্ধার করতে গিয়ে কর্মীর মৃত্যু বা এ নিয়ে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। তবে ফেসবুকে আফজাল খানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে হাসপাতালে ভর্তি শফিকুরের কাছ থেকে নেওয়া একটি স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও পোস্ট করেছেন। ভিডিওতে শফিকুরকে বলতে শোনা যায়, আফজাল বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করার পর উদ্ধারকাজ করতে বলেছিলেন, কিন্তু তাঁরা সে সময় দেননি। তাসফিয়ানের মৃত্যুতে সবাই শোকাহত, এ নিয়েও ভিন্ন একটি পোস্ট দিয়েছেন আফজাল।

তাসফিয়ানের মৃত্যুর পর দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তি কেন ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁর এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল কি না, উদ্ধারের আগে নিরাপত্তামূলক সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না—এসব প্রশ্ন সামনে এসেছে।

আটকে পড়া পশুপাখি উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা ও আফজালকে নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে সরকারের জরুরি সেবা ৯৯৯–এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করছে বলে এত দিন ফেসবুকসহ নানা উপায়ে প্রচার করেছে রবিনহুড। তবে ৯৯৯–এর কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের আনুষ্ঠানিক বা লিখিত কোনো চুক্তি হয়নি। তবে পশুপাখি উদ্ধারে সহায়তা চেয়ে কেউ ফোন করলে কখনো কখনো তাদের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর গণমাধ্যম ও জনসংযোগ কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংস্থাটির সঙ্গে লিখিত বা আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি নেই। ঢাকা শহরে আটকে পড়া পোষা প্রাণী উদ্ধারে কাজ করে—এটা জানাতে তারা আমাদের কাছে আসে। বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এবং বিভিন্ন উদ্ধারকাজের ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখায়। সংস্থাটির উদ্ধারকাজে দক্ষতা আছে কি না, তা যাচাই–বাছাই করা হয়নি। পোষা প্রাণী উদ্ধারসংক্রান্ত কোনো ফোন এলে আমরা প্রথমত বন বিভাগ, দ্বিতীয়ত ফায়ার সার্ভিস এবং নিরুপায় হলে সংস্থাটির কাছে রেফার করি।’

২০১৯ সাল থেকে রবিনহুড দ্য অ্যানিমেল রেসকিউয়ার সরকারের জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করছে বলে এত দিন প্রচার করেছে সংস্থাটি। তবে ৯৯৯-এর কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের আনুষ্ঠানিক বা লিখিত কোনো চুক্তিও হয়নি।

আনোয়ার সাত্তার বলেন, ‘আমি শুনেছি, সংস্থাটি তাদের গাড়িতেও নাকি ৯৯৯–এর অন্তর্ভুক্ত—এমন কথা লিখে রেখেছে। আইনত তারা তা করতে পারে না। শুনেছি টিয়া পাখি উদ্ধার করতে গিয়ে এক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া বা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে তো এমন উদ্ধারকাজ পরিচালনা করতে পারে না সংস্থাটি।’

রবিনহুড দ্য অ্যানিমেল রেসকিউয়ারের প্রতিষ্ঠাতা আফজাল ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে দাবি করেন, কাজে সততা আছে বলেই জাতীয় জরুরি সেবার মতো একটি জায়গায় নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। পুলিশ, র‍্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রশাসনিক সহায়তা পাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

উদ্ধারকর্মীদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই

আফজাল খান বর্তমানে ‘রবিনহুড’ নামেই পরিচিত। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে তিনি জানিয়েছেন, দেশ–বিদেশের গণমাধ্যমই বিশেষ কাজের জন্য তাঁকে ‘রবিনহুড’ বলে আখ্যায়িত করেছে। ঢাকায় পৈতৃক বাড়িতে আফজাল বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা অসুস্থ কুকুর–বিড়াল পালেন। এ ছাড়া অ্যানিমেল কেয়ার ট্রাস্ট বাংলাদেশ নামের তিনি একটি ক্লিনিক চালান। কোথাও আটকে পড়া পোষা প্রাণী উদ্ধারে তিনি টাকাপয়সা নেন না বলে দাবি করলেন। তবে ক্লিনিকে টাকার বিনিময়ে পশুপাখির চিকিৎসা করানো হয়।

ভিডিওতে এলাকার সবাই বলতাছে, বিদ্যুতের তারে আপনারা এইভাবে কাজগুলো কইরেন না। তবু অন্যায়ভাবে এ কাজটা কেন করতে গেল? আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
নাজমুল ইসলাম, তাসফিয়ান ইসলামের বাবা

গত সোমবার মুঠোফোনে আফজাল প্রথম আলোকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ধারকাজের জন্য তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তবে গত ১৩ বছরে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন তিনি।

আফজাল বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে রোলিং করতে পারতাম। উদ্ধারকাজে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানো শেখায়। কুকুর–বিড়াল উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস দক্ষ না। আমাদের যন্ত্রপাতি আছে। অ্যানিমেল লাভার হলে অ্যানিমেল কাছে আসে, অন্যদের কাছে সেভাবে আসে না। ১৩ বছর ধরে কাজ করছি, এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি।’

কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে টিয়া পাখি উদ্ধারের সময় ঘটা দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে আফজাল বলেন, ‘বিদ্যুতের লাইন অফ (সরবরাহ বন্ধ) করা ছাড়া করা সম্ভব না। আমি কর্মীদের আগেই কিছু করতে না করি। হাতের কাছেই ছিল পাখিটা। তাসফিয়ান তো উদ্ধারকারী না। অতি উৎসাহী হলে যা হয়! এর আগে দুই বছর চাকরিতে রাখি নাই তাঁর এ ধরনের অতি উৎসাহী আচরণের জন্য।’

রবিনহুড দ্য অ্যানিমেল রেসকিউয়ারের প্রতিষ্ঠাতা আফজাল খান  

তাসফিয়ানের বাবা জানালেন, তাঁর ছেলেকে দিয়ে উদ্ধারকাজ, দেহরক্ষীর কাজসহ বিভিন্ন কাজ করানো হলেও আফজাল খান বেতন দিতেন না। তবে আফজাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, আতিফ ১০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন। আর সেদিনের টিয়া পাখি উদ্ধারসংক্রান্ত কলটি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে রেফার করা ছিল না।

তাসফিয়ানের মৃত্যুর দায় কার—এমন প্রশ্নে আফজাল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মারা যাওয়ার আগে তাসফিয়ান আমাদের কাছে স্টেটমেন্ট (বিবৃতি) দিয়ে গেছে যে সেদিন সে কথা না শুনে অন্যায় করেছে।’

দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শফিকুর রহমান। তিনি রবিনহুড দ্য অ্যানিমেল রেসকিউয়ারের প্রধান উদ্ধারকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর মুগদায় থাকেন শফিকুর। শুরু থেকেই এ সংস্থার সঙ্গে আছেন তিনি। বর্তমানে ২০ হাজার টাকা বেতন পান।
শফিকুর স্বীকার করলেন, তাঁরও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাঁর বস আফজালের কাছ থেকে। এ ছাড়া আগে তিনি রংমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন বলে দেয়াল বেয়ে উঁচু ভবনে ওঠা তাঁর কাছে কঠিন না।

কেরানীগঞ্জে টিয়া পাখি উদ্ধারের ঘটনা প্রসঙ্গে শফিকুর জানালেন, বিদ্যুতের তারে ঘুড়ি বা অন্য কোনো সুতার সঙ্গে জীবন্ত টিয়া ঝুলে ছিল। তাসফিয়ান বিড়াল ধরার লোহার ক্যাচার দিয়ে পাখিটি ধরতে গেলে দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ উদ্ধারকাজের সময় আফজাল ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি আগে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করার কথা বলেছিলেন বলে শফিকুর উল্লেখ করলেন।

‘ছেলে হত্যার’ বিচার চান বাবা

তাসফিয়ান তাঁর মা–বাবার একমাত্র ছেলে। রাজধানীর লালবাগে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তাসফিয়ানের বাবা নাজমুল ইসলাম বললেন, দুর্ঘটনায় ছেলে মারা যাওয়ার পর আফজাল খান ও তাঁর সংস্থার বিভিন্ন নেতিবাচক তথ্য জানতে পারছেন। এর আগে ছেলে তাঁদের কাছে এ নিয়ে কোনো কিছু প্রকাশ করেননি।

নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলেটারে মার্ডার (হত্যা) করে ফেলছে। কোনো ট্রেনিং (প্রশিক্ষণ) ছাড়া, বাইরে থেকে ডোনেশন (অনুদান) নিয়ে চলছে সংস্থাটি। আমার ছেলে বডিগার্ড (দেহরক্ষী) হিসেবে কাজ করত। কিন্তু সেদিন টিয়া পাখি উদ্ধার করতে ছেলেকে আফজালই পাঠান, তার ভিডিও আছে। ভিডিওতে এলাকার সবাই বলতাছে, বিদ্যুতের তারে আপনারা এইভাবে কাজগুলো কইরেন না। তবু অন্যায়ভাবে এ কাজটা কেন করতে গেল? আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’