শেখ হাসিনার দেশত্যাগের আগে-পরে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত বেশির ভাগ কাউন্সিলরের কার্যালয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ঠিক দুই দিন আগে ৩ আগস্ট ভোরে গোপনে দেশ ছাড়েন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। আর ৫ আগস্ট দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশছাড়ার খবর প্রচারিত হওয়ার পরই আত্মগোপনে চলে যান ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলররা। একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটির আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলরাও গা ঢাকা দিয়েছেন। অবশ্য আত্মগোপনে গেলেও কাউন্সিলরদের কেউ কেউ মুঠোফোন সচল (হোয়াটসঅ্যাপ চালু) রেখেছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে সাধারণ কাউন্সিলের পদ ৭৫টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর ৬৭ জন। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে সাধারণ কাউন্সিলের পদ ৫৪টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর ৫১ জন। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের আগে-পরে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দুই সিটির আওয়ামী লীগ–সমর্থিত বেশির ভাগ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দাপ্তরিক কার্যালয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
৫ আগস্ট দুপুর থেকে গতকাল রোববার (১১ আগস্ট) পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটির আওয়ামী লীগের ১১৮ জন কাউন্সিলরের কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কোনোটি ভাঙচুর করা হয়েছে, কোনোটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলরদের মধ্যে ৪১ জনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। এর মধ্যে ছয়জনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলা গেছে।
তবে আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপিসহ অন্য দলের যেসব কাউন্সিলর ঢাকায় রয়েছেন, তাঁদের কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাধারণ কাউন্সিলরদের মধ্যে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ৬ জন। এর বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একজন ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একজন কাউন্সিলর রয়েছেন। সব মিলিয়ে দক্ষিণ সিটির ৭৫টি কাউন্সিলর কার্যালয়ের মধ্যে সেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে মাত্র ৮টিতে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ড (মানিকনগর এলাকা), ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড (সিদ্দিক বাজার ও নাজিরাবাজার এলাকা), ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড (যাত্রাবাড়ীর ধলপুর), ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড (পূর্ব জুরাইন ও মুরাদপুর), ৬১ নম্বর ওয়ার্ড (দনিয়া), ৬৬ নম্বর ওয়ার্ড (ডগাইর ও বামৈল), ৬৭ নম্বর ওয়ার্ড (সারুলিয়া) ও ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড (ত্রিমোহনী এলাকা)।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাধারণ কাউন্সিলরদের মধ্যে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ৬ জন। এর বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একজন ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একজন কাউন্সিলর রয়েছেন।
একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটির সাধারণ কাউন্সিলরদের মধ্যে বিএনপির রাজনীতি করেন দুজন। এর বাইরে জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন একজন কাউন্সিলর। সব মিলিয়ে উত্তর সিটির ৫৪টি কাউন্সিলর কার্যালয়ের মধ্যে চালু আছে মাত্র ৩টি। এর মধ্যে রয়েছে উত্তর সিটির ২ নম্বর ওয়ার্ড (মিরপুর ১২ নম্বর এলাকা), ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড (দক্ষিণখান) এবং ৩১ নম্বর ওয়ার্ড (মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকা)।
ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সশরীর অফিসে না গেলেও কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখছেন। মুঠোফোনে তাঁদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
সব মিলিয়ে উত্তর সিটির ৫৪টি কাউন্সিলর কার্যালয়ের মধ্যে চালু আছে মাত্র ৩টি। এর মধ্যে রয়েছে উত্তর সিটির ২ নম্বর ওয়ার্ড (মিরপুর ১২ নম্বর এলাকা), ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড (দক্ষিণখান) এবং ৩১ নম্বর ওয়ার্ড (মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকা)।
দক্ষিণে কোথাও ভাঙচুর, কোথাও আগুন
কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি অনেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বাসায়ও হামলা হয়েছে। লালবাগ এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর হয়নি। তবে এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা হয়েছে। বাসার নিচে দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয় ৫ আগস্ট বিকেলে। তাঁর বাসার পাশেই কার্যালয়।
হাসিবুর রহমানের সঙ্গে গত বুধবার মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই সংকটের সময় তাঁর প্রতিপক্ষরা ক্ষতি করতে পারেন, তাই নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার এক দিন আগে ৪ আগস্ট সকালে বাংলামোটর মোড়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। তখন পরীবাগ এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়।
চকবাজারের হোসেনী দালান এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের কার্যালয়ও তছনছ করা হয়েছে। কাউন্সিলর ওমর বিন আব্দুল আজিজ বুধবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পুরো কার্যালয় তছনছ করে ফেলেছে। পারিবারিক ও ব্যবসায়িক কাগজপত্র লুট করে নিয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার এক দিন আগে ৪ আগস্ট সকালে বাংলামোটর মোড়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। তখন পরীবাগ এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়।
২১, ২৬ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাশাপাশি আরও তিনটি ওয়ার্ড (৫, ২৪ ও ২৫) কাউন্সিলরের কার্যালয় বুধবার ঘুরে দেখেছে প্রথম আলো। এর কোনোটিতে ভাঙচুর করা হয়েছে, কোনোটিতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতির কারণে নাগরিকদের কিছু সময় ধৈর্য ধরতে হবে।
মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস কবে দেশে ফিরবেন—এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এদিকে সাধারণ কাউন্সিলরদের পাশাপাশি কোথাও কোথাও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলরের বাসাবাড়ি ও কার্যালয়েও হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৬, ১৭, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নারগীস মাহতাব প্রথম আলোকে বলেন, কাঁঠালবাগান এলাকায় তাঁর বাসার নিচেই কার্যালয়। তাঁর কার্যালয় ও বাসা ভাঙচুর করা হয়েছে।
৫ আগস্ট সন্ধ্যায় একদল লোক এসে কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তারা কার্যালয়টি পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পাশে আমাদের দোকান হওয়ার অনেক অনুরোধ করে তাদের আগুন দিতে মানা করি। কার্যালয়ে ঢোকার দরজায় কারা দেয়াল তুলেছে জানি না।মুদিদোকানি মহসীন আহমেদ
উত্তরেও একই অবস্থা
ঢাকা উত্তর সিটির পাঁচজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় গত বৃহস্পতিবার ঘুরে দেখেছে প্রথম আলো। এর মধ্যে লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সীমানাদেয়াল ঘেঁষে ছিল ঢাকা উত্তর সিটির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলামের কার্যালয়। বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ে ঢোকার দরজা দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি যে একসময় কাউন্সিলরের কার্যালয় ছিল, তা এখন বোঝার উপায় নেই।
কার্যালয়ের পাশের মুদিদোকানি মহসীন আহমেদ বললেন, ‘৫ আগস্ট সন্ধ্যায় একদল লোক এসে কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তারা কার্যালয়টি পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পাশে আমাদের দোকান হওয়ার অনেক অনুরোধ করে তাদের আগুন দিতে মানা করি। কার্যালয়ে ঢোকার দরজায় কারা দেয়াল তুলেছে জানি না।’
উত্তর সিটির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ সলিমউল্লাহর কার্যালয় ছিল মোহাম্মদপুরে সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের নিচতলায়। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলার সময় গত ১৯ জুলাই এই সেন্টারের ভাঙচুর চালানো হয়। সেদিন কাউন্সিলরের কার্যালয়ও ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।
২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব ইফতেখারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউন্সিলর কার্যালয়ে আসছেন না। আমরা যতটুকু পারছি, দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে নিচ্ছি।’
মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকার ২০ নম্বর সড়কে ঢাকা উত্তর সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তফাজ্জল হোসেনের কার্যালয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে মোহাম্মদপুরের চান মিয়া আবাসিক এলাকায় ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদের কার্যালয়েও।
অন্যদিকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের নিরাপত্তা প্রহরী ইসমাইল ইসলাম জানান, কাউন্সিলর কোথায় আছেন, তা জানেন না। ভয়ে ওয়ার্ড সচিবও কার্যালয়ে আসছেন না।
এর মধ্যে ৭ নম্বর কাউন্সিলর তফাজ্জল হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কার্যালয়ে যা যা ছিল, সব লুট করে নিয়ে গেছে। নিরাপত্তার কারণে প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের নিরাপত্তা প্রহরী ইসমাইল ইসলাম জানান, কাউন্সিলর কোথায় আছেন, তা জানেন না। ভয়ে ওয়ার্ড সচিবও কার্যালয়ে আসছেন না।
ঢাকা উত্তর সিটিতে কত কাউন্সিলরের কার্যালয়ে ভাঙচুর-আগুন দেওয়া হয়েছে, তা নিরূপণ করা হচ্ছে বলে জানান সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক ওয়ার্ডে সচিবরাও ভয়ে কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত নাগরিক সেবা কীভাবে চালু করা যায়, সে বিষয়গুলো ভাবা হচ্ছে।
বিএনপির কাউন্সিলররা সক্রিয়
আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলররা আত্মগোপনে চলে গেলেও বিএনপি–সমর্থিত কাউন্সিলররা এলাকাতেই আছেন। বিএনপি–সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মামুন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এমন কোনো অপকর্ম করেননি যে তাঁকে এলাকা ছাড়তে হবে। যারা মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তারা নিজেদের বাঁচাতে এলাকা ছেড়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে বিএনপি–সমর্থিত দুজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিয়মিত কার্যালয়ে যাচ্ছেন, দাপ্তরিক কাজ করছেন। এর মধ্যে উত্তর সিটির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সচিব সামাউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ওয়ার্ড কার্যালয়ে কোনো হামলা হয়নি। কাউন্সিলরও নিয়মিত অফিস করছেন।
দেশ ছেড়েছেন দুজন কাউন্সিলর
ঢাকা উত্তর সিটির দুজন কাউন্সিলর দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁদের একজন ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি এখন বাহরাইনে আছেন বলে নিজেই মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান।
জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমার বাসায় পরপর চারবার আক্রমণ করা হয়েছে। কোনো নিরাপত্তা পাচ্ছিলাম না, তাই শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার পরদিন বাহরাইনে চলে এসেছি।’
উত্তর সিটির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকির হোসেনও দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ দুটি সূত্র তাঁর বিদেশে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।