তৃতীয় ও পঞ্চমের অর্ধেক শিক্ষার্থীর বাংলায় দক্ষতার ঘাটতি, গণিতে আরও বেশি

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন এক শিক্ষক
ফাইল ছবি

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায় প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে থাকার তথ্য উঠে এসেছে। এবার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ২০২২–এর প্রতিবেদনেও একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে। এর মধ্যে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। আর তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না।

কক্সবাজারের একটি হোটেলে গতকাল শনিবার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উদ্যোগে ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় আয়োজিত এক কর্মশালায় জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রাথমিক শিক্ষায় পড়ালেখা বা শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে আছে সিলেট বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তুলনামূলকভাবে চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে আছে। তবে এগিয়ে আছে ঢাকা ও ময়মনসিংহের শিক্ষার্থীরা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত এ জরিপে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির গণিত ও বাংলা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিভাগের পঞ্চম ও তৃতীয় শ্রেণির মোট ৫৪ হাজার ২৩২ শিক্ষার্থীর ওপর এ জরিপ চালানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে তৃতীয় শ্রেণির ২৮ হাজার ৭৫২ ও পঞ্চম শ্রেণির ২৫ হাজার ৪৮০ শিক্ষার্থী।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এখনো তৃতীয় শ্রেণির ৫১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। আর তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। বিপরীতে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে। আর গণিতে তৃতীয় শ্রেণির ৩৯ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করছে।

এর আগে করোনাকালে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিখনক্ষতি নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এক গবেষণায় উঠে এসেছিল, করোনা মহামারির সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি আরও বেড়েছে। ওই গবেষণার তথ্য বলছে, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।

এখন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নেও প্রাথমিক শিক্ষার নানা দুর্বলতার দিক উঠে এসেছে। সাধারণত প্রতি দুই বছর পরপর জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন জরিপ পরিচালনা করে প্রাথমিক বিভাগ। কিন্তু ২০১৭ সালের পর ২০২২ সালে এসে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে মাঝে এ জরিপ স্থগিত ছিল। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে ২০১৩ সালের জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন কমেছে।

সাধারণভাবে একেকটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের যেসব দক্ষতা বা যোগ্যতা অর্জন করার কথা বা যেসব প্রত্যাশা পূরণ করার কথা, তার প্রাপ্তিকে শিখন অর্জন বলা হয়।
জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ২০২২–এর প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, শিখন ও সার্বিক ফলাফলে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছে।

প্রতিবেদনে পড়ালেখার অগ্রগতি, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ, জ্ঞান ও অনুধাবন স্তরের প্রশ্ন বোঝার দক্ষতা অর্জনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশব্যাপী শিক্ষকস্বল্পতা দূরীকরণে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম, স্কুলে স্কুলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার নেতৃত্বে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদারকি কার্যক্রম বাড়ানো, প্রাক্‌–প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রম আনন্দদায়ক করতে শ্রেণিকক্ষ সজ্জিত করা, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম জোরদার করা।

ওই কর্মশালায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘২০১৭ সালের জরিপের চেয়ে ২০২২ সালের জরিপের ফলাফল নিম্নমুখী হবে বলে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু টেনেটুনে সমান সমান হয়েছি। ছেলেদের তুলনায় সব বিভাগে মেয়েরা এগোচ্ছে। এটি ভালো। নারী শিক্ষার হার বাড়ছে। তবে ছেলেরা পিছিয়ে পড়াও উদ্বেগের। যেসব বিভাগে পিছিয়ে আছি, সেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমান্তরালভাবে এগোনোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শিক্ষকেরা আন্তরিক ও সৃজনশীল হলে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ক্রমেই বাড়বে।’

ফরিদ আহাম্মদ বলেন, প্রতিবছর ছয় হাজার শিক্ষক অবসর গ্রহণ করেন। তাই শিক্ষকসংকট লেগেই থাকে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমে নিয়োগ প্যানেল তৈরি করে দেশে শিক্ষকসংকট দূরীকরণে প্রতি ছয় মাস পরপর শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণ করছে মন্ত্রণালয়। আগামী বছর থেকে এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। ঝরে পড়া রোধে শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা আবারও চালু হবে। দেড় শ উপজেলায় আগামী বছর থেকে ‘স্কুল মিল’ দেওয়া হবে।