সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) যেন ফিরিয়ে এনেছে শায়েস্তা খাঁর আমল। সংস্থাটি জ্বালানি তেল পরিবহনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে, যেখানে প্রতি টনে ব্যয় হবে মাত্র এক টাকা।
এত কম টাকায় কীভাবে তেল পরিবহন করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, সামান্য টাকায় জ্বালানি তেল পরিবহনে চুক্তিতে আগ্রহী হওয়ার পেছনে রয়েছে চুরি। জ্বালানি তেল পরিবহনের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটি তেলের একটি অংশ পথে বিক্রি করে দেয়। সেটিই তাদের আয়ের উৎস।
বিআইডব্লিউটিসি জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য চুক্তি করেছে বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার্স নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার্সের মালিক মো. জাফর উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমরা তেল পরিবহন করছি। এবারও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে আমরা কাজ পেয়েছি।’
সব মিলিয়ে দুই বছরে ১ হাজার ৬৮০ টন জ্বালানি তেল পরিবহনে ব্যয় হবে অন্তত ২১ লাখ টাকা। কিন্তু বিআইডব্লিউটিসির ব্যয় হবে মাত্র প্রতি টনে এক টাকা। যেন তা শায়েস্তা খাঁর আমলের মতো।
মাত্র এক টাকায় এক টন জ্বালানি তেল পরিবহন কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে জাফর উল্লাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। সে ভালো বলতে পারবে।’
জাফর উল্লাহর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা একই সঙ্গে আরও অনেকের তেল পরিবহন করি। তাই সরকারি কাজটা সুনামের জন্য নিয়ে থাকি। এটাতে সুনাম বাড়ে।’ তিনি তেলের একাংশ বিক্রি করে দেওয়ার বিষয় অস্বীকার করেন।
সরকারের নৌপরিবহন সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি। চট্টগ্রাম থেকে তাদের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনকারী সাতটি নৌযান চলাচল করে। এসব নৌযান চালাতে তারা সরকারি জ্বালানি তেল বিপণনকারী সংস্থা পদ্মা অয়েল কোম্পানি ও মেঘনা অয়েল কোম্পানি থেকে ডিজেল কেনে।
পদ্মা ও মেঘনা সাধারণত চট্টগ্রামে তেল সরবরাহ করে পতেঙ্গার মজুতাগার বা ডিপো থেকে। এই ডিপো থেকে তেল বিআইডব্লিউটিসির জাহাজে নিতে নৌপরিবহন কোম্পানি বাছাই করতে গত ৩০ মে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর এক দিন পর গত ১ জুন একটি স্বল্প পরিচিত ইংরেজি দৈনিকে দুই বছরের জন্য জ্বালানি তেল পরিবহনের দরপত্রের বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়।
দরপত্রে অংশ নেয় চারটি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার্স, ইস্টার্ন বাংকার সার্ভিস, পলিকর্ন ইন্টারন্যাশনাল ও এমএএস ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল।
বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার্স বিআইডব্লিউটিসির চট্টগ্রামের জাহাজগুলোর জন্য জ্বালানি তেল পরিবহনে দুই বছরে দরপ্রস্তাব করেছে ১ হাজার ৬৮০ টাকা। এই টাকায় তারা ১ হাজার ৬৮০ টন জ্বালানি তেল পরিবহন করবে। মানে হলো, প্রতি টনে ব্যয় হবে মাত্র ১ টাকা।
কয়েক বছর ধরে আমরা তেল পরিবহন করছি। এবারও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে আমরা কাজ পেয়েছি।বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার্সের মালিক মো. জাফর উল্লাহ
ইস্টার্ন বাংকার সার্ভিসও বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার্সের সমান দরপ্রস্তাব করেছিল। সূত্র বলছে, তারা আসলে বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার্সেরই একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান।
পলিকর্ন ইন্টারন্যাশনাল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৮০ টাকা এবং এম এ এস ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৬৮০ টাকা দরপ্রস্তাব করে। তবে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পায় বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার্স।
দরপত্র কমিটির প্রধান ছিলেন বিআইডব্লিউটিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সামশুদ্দিন আহম্মদ। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার্স দুই বছরের জন্য কার্যাদেশ পেয়েছে। তারা আগেও তেল পরিবহন করেছে। এবারও করছে।
নৌযানে জ্বালানি তেল পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যদি ৫ শতাংশ তেলও বিক্রি করে দেওয়া হয়, তার বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৯০ লাখ টাকার বেশি। এই টাকা ভাগাভাগি করা হয়।
জ্বালানি তেল পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পতেঙ্গা থেকে চট্টগ্রামের বিআইডব্লিউটিসির জাহাজগুলোতে প্রতিবার একটি তেলবাহী নৌযান পাঠাতে ব্যয় হবে অন্তত ২০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ডিপোতে ভিড়লেই ভেড়ানোর মাশুল বা বার্থিং ফি দিতে হবে ১ হাজার ৫৫৮ টাকা। সব মিলিয়ে দুই বছরে ১ হাজার ৬৮০ টন জ্বালানি তেল পরিবহনে ব্যয় হবে অন্তত ২১ লাখ টাকা। কিন্তু বিআইডব্লিউটিসির ব্যয় হবে মাত্র প্রতি টনে এক টাকা। যেন তা শায়েস্তা খাঁর আমলের মতো।
মোগল আমলে বাংলার একজন বিখ্যাত সুবেদার বা প্রাদেশিক শাসক ছিলেন শায়েস্তা খাঁ। দুই দফায় ২২ বছর তিনি বাংলা শাসন করেন। প্রথমে ১৬৬৪ থেকে ১৬৭৮ সাল এবং দ্বিতীয়বার ১৬৮০ থেকে ১৬৮৮ সাল। বলা হয়, তাঁর শাসনামলে ঢাকার ব্যাপক উন্নতি হয়। শায়েস্তা খাঁ এখনকার মানুষের কাছে বেশি বিখ্যাত হয়ে আছেন এই কারণে যে তাঁর শাসনামলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত।
আপাতদৃষ্টে বিআইডব্লিউটিসি সস্তায় তেল পরিবহনের সুযোগটি পাচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ হলো, যত তেল ডিপো থেকে জাহাজে যাওয়ার কথা, ততটা যায় না।
বিআইডব্লিউটিসি যে ১ হাজার ৬৮০ টন তেল পরিবহন করবে, তার দাম ১৮ কোটি টাকার বেশি। নৌযানে জ্বালানি তেল পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যদি ৫ শতাংশ তেলও বিক্রি করে দেওয়া হয়, তার বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৯০ লাখ টাকার বেশি। এই টাকা ভাগাভাগি করা হয়।
মাত্র ১ হাজার ৮৬০ টাকায় দুই বছর ধরে ১ হাজার ৬৮০ টন তেল পরিবহন কীভাবে সম্ভব, এমন প্রশ্নে বিআইডব্লিউটিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সামশুদ্দিন আহম্মদ নিশ্চুপ থাকেন। তাঁকে আবার জিজ্ঞেস করা হয়, দরপত্রে টাকার অঙ্কে কোনো ভুল হয়নি তো? তিনি বলেন, ‘না, কোনো ভুল হয়নি।’