ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনপ্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নামে একের পর এক মামলা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হত্যা মামলা। এভাবে ঢালাও মামলার কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কিছু কর্মকর্তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলা দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। যাঁরা বিগত সরকারের সময় সীমা লঙ্ঘন করেছেন, বাড়াবাড়ি করেছেন, তাঁদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ মুখ্য সচিবের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিনজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। দুজন আত্মগোপনে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অতীতে কখনো হত্যা মামলা হয়নি। গ্রেপ্তারও হননি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ ও নজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্য দুই মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও আহমেদ কায়কাউসের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। একজন দেশের বাইরে, অন্যজন আত্মগোপনে।
প্রশাসনের আরেক শীর্ষ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দায়িত্বে থাকা দুই মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ও কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাঁরাও গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন।
আরেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের নামে যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। অবশ্য মামলার বাদী বলছেন, ‘ভুলবশত’ তাঁকে আসামি করা হয়েছে। তিনি গত বুধবার শেষ অফিস করে অবসরে গেছেন।
এ ছাড়া বেশ কয়েকজন সচিবের বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা হয়েছে। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দুই মাসে বেশ কয়েকজন সচিবকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) এবং বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের নামে মামলা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন চারজন সচিব। তাঁরা হলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও একই মন্ত্রণালয়ের আরেক সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামাল এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া সচিব মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ও ফয়েজ আহমেদ এবং সাবেক সচিব আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।
আমলাদের বিরুদ্ধে করা মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগই হত্যা মামলা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমলাদের বিরুদ্ধে এমন মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা কখনো ঘটেনি।
প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নামে মামলা ও গ্রেপ্তার নিয়ে সাবেক পাঁচজন সচিব, একজন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ, দুজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও বর্তমানে বিভিন্ন পদে কর্মরত পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। এতে দুই ধরনের মত উঠে এসেছে।
একপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, বিগত ১৫ বছরে আমলারা রাজনীতিবিদদের মতো আচরণ করেছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগের মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যের মতো কথা বলতেন। তা ছাড়া ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন তাঁদের মাধ্যমে হয়েছে। ওই দায় তাঁরা এড়াতে পারেন না। এতে আমলাদের ওপর মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
এই পক্ষ আরও বলছে, বিগত ১৫ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনে অনেক যোগ্য কর্মকর্তাকে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়েছে। এই দায়ভার তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবেরা এড়াতে পারেন না। সব মিলিয়ে আমলারা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। তাঁদের কর্মকাণ্ডের খেসারত এখন পুরো আমলাতন্ত্রকে দিতে হচ্ছে।
আরেক পক্ষের যুক্তি হচ্ছে, আমলারা কেবল বিগত সরকারের আদেশ বাস্তবায়ন করেছেন। তবে যাঁরা সীমা লঙ্ঘন করেছেন, বাড়াবাড়ি করেছেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু যেভাবে শীর্ষ কর্মকর্তাদের নামে ঢালাও মামলা হচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে—তাতে অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এতে প্রশাসনের কাজে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। যাঁরা অবসরে গেছেন, তাঁরাও গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন।
এই পক্ষ বলছে, কর্মকর্তাদের নামে মামলা ও গ্রেপ্তার প্রশাসনে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অন্য সরকার এসে একই পথে হাঁটবে। প্রশাসনের জন্য এটা ভালো হবে না। এখন যা হচ্ছে, তা নজিরবিহীন।
তবে সবাই একমত, ঢালাওভাবে আমলাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে অপরাধ গৌণ করে ফেলা হচ্ছে। এতে অপরাধ প্রমাণিত হবে না। মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবেন।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর নামে যে এলাকায় মামলা হয়েছে, তিনি সেখানে কখনো যাননি। মামলার বাদী অজ্ঞতাবশত কিংবা না বুঝে অথবা প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাঁর নামে মামলা করেছেন। তিনি কখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলে দাবি করেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও আমলাদের এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়নি। তখন আমলাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছিল। হাতে গোনা দু-একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
জনপ্রশাসন সূত্র বলছে, ২০০৭ সালে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদ একবার এক বৈঠকে সচিবদের নির্বিঘ্নে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই বৈঠকে উপস্থিত এক সচিব গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ওই বৈঠকে তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছিলেন, ‘আমরা ভয়ের মধ্যে আছি। আমলাদের মধ্যে ভয় থাকলে কাজ করবেন কীভাবে।’
ঢালাওভাবে মামলার আসামি করার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। এখন ঢালাওভাবে আসামি করা হচ্ছে। থানায় মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা দরকার।
গত ১৫ বছরে আমলারা যেভাবে খবরদারি করেছেন, কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা রেখেছেন এবং কখনো কখনো রাজনীতিবিদদের মতো আচরণ করেছেন, তা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নেতাদের মুখে উঠে এসেছে। ২০২১ সালে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছিলেন, রাজনীতির মাঠে রাজনীতিবিদেরা নেই। রাজনীতির মাঠে খেলছেন আমলারা। রাজনীতিবিদেরা সাইডলাইনে বসে খেলা দেখছেন। একই বছর আমলাদের অতি খবরদারি ও কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা নিয়ে সংসদ সদস্যরা সংসদে বক্তব্য দেন।
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলার ঘটনার পর প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া বিবৃতি নিয়েও ২০২১ সালে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম নিজেই বলেছিলেন, এভাবে বিবৃতি দেওয়া ঠিক হয়নি।
কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুপারিশে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভাপতি হচ্ছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। পদোন্নতিবঞ্চিত এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৫ বছরে যাঁরা মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব হয়েছেন, তাঁরা বৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন। তাঁরা রাজনৈতিক বিবেচনায় যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেননি। বিগত সরকারকে ফ্যাসিস্ট হতে সহায়তা করেছিলেন আমলারা। এখন তাঁদের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, সরকার আসবে, সরকার যাবে। আমলাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে। কিন্তু গত ১৫ বছরে দলীয় আমলাতন্ত্র হয়েছে। আমলারা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মিশে গেছেন, যার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে। এখন যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে।