ভবনটি নির্মাণে ১৬৩ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১১ সালে। ছয় বছর ধরে এভাবে পড়ে আছে ভবনটি।
রাজধানীর পুরান ঢাকার জনসন রোডের মোড়ে গেলে দেখা যাবে ২০ তলা একটি ভবন। ওই এলাকায় এর চেয়ে বেশি উচ্চতার আর কোনো ভবন নেই। তাই চোখ এড়ানোর সুযোগ নেই। এটাও চোখে পড়বে যে ভবনটি পুরোপুরি খালি। এক বছর, দুই বছর নয়—ছয় বছর ধরে এভাবে পড়ে আছে।
‘টাওয়ার ভবন’ নামে এই ভবন নির্মাণ করেছে ঢাকা জেলা পরিষদ। কথা ছিল, ভবনের দোকান ও জায়গা (স্পেস) ভাড়া দিয়ে বিপুল আয় হবে। সেই টাকা দিয়ে ঢাকা জেলার উন্নয়নকাজ করা হবে। এই ‘সুফল’ দেখিয়ে ১৬৩ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এখন আয় তো দূরে থাক, ভবনটি বোঝায় পরিণত হয়েছে।
ঢাকা জেলা পরিষদ ভবনটি নির্মাণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন নেয়নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে যে প্রশাসনিক অনুমোদন নিতে হয়, সেটাও নেয়নি তারা। নিজেরা প্রথম যে নকশা করেছিল, তা পরে বদলে ফেলা হয়।
‘২০১৭ সালে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর টাওয়ার ভবনের খবর নিয়ে জানতে পারি কোনো ফাইল নেই। সব গায়েব হয়ে গেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে ভবনের নকশা দেখতে চাই। তারা নকশাও দেখাতে পারেনি।’মাহবুবুর রহমান, ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক
অনিয়ম নজরে আসার পর শেষ দিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেয়। এরপর আর প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ করতে পারেনি ঢাকা জেলা প্রশাসন। ওদিকে ভবন নির্মাণ–সম্পর্কিত নথিপত্র জেলা প্রশাসন থেকে গায়েব হয়ে গেছে।
ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৭ সালে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর টাওয়ার ভবনের খবর নিয়ে জানতে পারি কোনো ফাইল নেই। সব গায়েব হয়ে গেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে ভবনের নকশা দেখতে চাই। তারা নকশাও দেখাতে পারেনি।’ তিনি বলেন, পরে ভবনের একটি নকশা করা হয়েছে। কিন্তু এখন মন্ত্রণালয় বলছে রাজউকের অনুমোদন নেই ভবনটির।
মাহবুবুর রহমান প্রশ্ন করেন, অনুমোদন ছাড়া প্রশাসনের সামনে কীভাবে ২০ তলা একটি ভবন হয়ে গেল?
উল্লেখ্য, ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক ছিলেন সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলা।
কেউ যদি অনিয়ম ও অনৈতিকভাবে ভবন নির্মাণ করে থাকে, অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া উচিত।তাজুল ইসলাম, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ঢাকা টাওয়ার ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে। পাঁচ বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে এসে বিল আটকে দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মূলত তখনই প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তত দিনে প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল।
এই প্রতিবেদক ৩ সেপ্টেম্বর ভবনটির অবস্থা দেখতে যান। তখন ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতে গেলে বাধা দেন নিরাপত্তাকর্মীরা। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছেন চারজন। তাঁদের একজন মুকুল মিয়া। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের অনুমোদন ছাড়া ভেতরে ঢোকা যাবে না।
ভেতরে ঢুকতে না পেরে ভবনের চারপাশ ঘুরে দেখা গেল, দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় বিভিন্ন জায়গায় শেওলা জমেছে। অযত্ন-অবহেলায় ভবনটি নষ্ট হচ্ছে।
ভবনটি নির্মাণে অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল কি না এবং রাজধানীর বুকে এত বড় একটি ভবন কীভাবে অনুমোদন ছাড়া নির্মিত হলো জানতে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ দপ্তরে তিনি নতুন এসেছেন। বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
নির্মাণকাজ বন্ধের কারণ হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ের কোনো প্রকল্প নিলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সম্মতি নিতে হয়। সেটি করা হয়নি। পুরান ঢাকায় ২০ তলা উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যায় কি না, সে বিষয়ে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। এসব কারণে প্রকল্পের বিল পরিশোধ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিসের ভিত্তিতে প্রকল্পের ব্যয় ১৬৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা–ও অজানা।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কেউ যদি অনিয়ম ও অনৈতিকভাবে ভবন নির্মাণ করে থাকে, অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া উচিত।
ঢাকা জেলা পরিষদের ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয়ের একটি বড় দৃষ্টান্ত। এটি দায়িত্বহীনতা ও জনগণের সম্পদ যে মূল্যবান, সে বিষয়ে সংবেদনশীলতা না থাকার উদাহরণ।ইফতেখারুজ্জামান, দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০ তলা ভবনের মধ্যে একটি তলা ঢাকা জেলা পরিষদের ব্যবহারের জন্য থাকার কথা ছিল। বাকি জায়গা দোকান, কমিউনিটি সেন্টার, আইনজীবীদের বসার জায়গাসহ নানা কাজে ব্যবহারের কথা। এর মধ্যে জেলা পরিষদ ভবনটিতে দোকানভাড়া দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায় ৬০ কোটি টাকা সালামি হিসেবে নিয়েছে।
যেসব ব্যবসায়ী দোকান বরাদ্দের জন্য টাকা দিয়েছেন, তাঁরাও বিপাকে পড়েছেন। কারণ, বিপুল অঙ্কের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বিনিয়োগ করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কবে নাগাদ ভবনটি চালু হবে, তার ঠিক নেই।
ভবনটি নির্মাণের ঠিকাদার তমা কনস্ট্রাকশন। সূত্র জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত কাজের বিল হিসেবে প্রায় ৬০ কোটি টাকা পেয়েছে। আরও ৬৫ কোটি টাকার মতো পাওনা রয়েছে।
জেলা পরিষদের কাছ থেকে টাওয়ার ভবনসংক্রান্ত সব নথি গায়েব হওয়ার পর নতুন করে নথিপত্র তৈরি করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের দাবি, নথি গায়েবের সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও জেলা পরিষদের একটি চক্র জড়িত। ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দুই দপ্তরে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা সবাই ঘটনা জানেন।
ঢাকা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মামুনুর রশীদ নথি হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। অবশ্য এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি, কর্তৃপক্ষ একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেনি।
ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, মামলা সুরাহা একটি লম্বা প্রক্রিয়া। তাই তাঁরা মামলায় যাননি। তিনি বলেন, যেটা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন রাজউকের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে নকশা চূড়ান্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চাইলে প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন দিতে পারে। কিন্তু তারা দিচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে যেনতেনভাবে প্রকল্প নেওয়া ও তা বাস্তবায়নের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ, প্রকল্প নিলেই ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। পরে দেখা যায়, প্রকল্পটি মানুষের উপকারে আসছে না।
দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা জেলা পরিষদের ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয়ের একটি বড় দৃষ্টান্ত। এটি দায়িত্বহীনতা ও জনগণের সম্পদ যে মূল্যবান, সে বিষয়ে সংবেদনশীলতা না থাকার উদাহরণ। তিনি বলেন, এই ভবন নির্মাণের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, যাঁরা সমস্যাটির সমাধান না করে ভবনটি ফেলে রেখেছেন, তাঁদের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
ভবনের নথি গায়েবের বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নথি গায়েব হয়েছে মানে এখানে বড় ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। যা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নথি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।