‘উপযুক্ত পাত্র’ পাওয়ায় ৪৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ

১৮ বছর বয়সের আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়া ঠিক মনে করছেন ৫০% অভিভাবক। সচ্ছল পরিবারেও বাল্যবিবাহের হার ৫০%।

বাল্যবিবাহ

গত বছর এসএসসি পাসের পরপরই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ১৬ বছর বয়সী মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। মেয়েটি এখন পড়ছে না। গত মঙ্গলবার মুঠোফোনে মেয়েটির মা–বাবার সঙ্গে কথা হয়। মেয়ের মা পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘১৬ বছর—কোথায় ছোট? আমার তো এর চেয়ে ছোট বয়সে বিয়ে হইছে।’ আর বাবা বললেন, ‘শহরে ছেলের নিজের সেলুন আছে। ভালো ছেলে পাইছি, তাই বিয়ে দিছি।’

গত মাসে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দেওরগাছ ইউনিয়নের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর (১৭) বিয়ে হয় এক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে। দুটি পরিবারই বেশ সচ্ছল। পল্লী সমাজ নামে স্থানীয় একটি সংগঠনের সভাপতি কোহিনূর আক্তার গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির বিয়ের খবর পেয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন। মেয়ের মা–বাবা তাঁদের আশ্বস্ত করলেন ‘শুধু আংটি পরানো হবে’। এর চার–পাঁচ দিন পর বরের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সী। ৭০ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রচার।

বাল্যবিবাহের পেছনে সাধারণভাবে দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাবকে বেশি দায়ী করা হলেও জরিপের তথ্য বলছে অন্য কথা। এ দুটির চেয়েও বাল্যবিবাহ দেওয়ার পেছনে অভিভাবকেরা ‘উপযুক্ত পাত্র’ পাওয়ার কথা বেশি বলছেন। দরিদ্র ও ধনী—দুই ধরনের পরিবারেই ঘটছে বাল্যবিবাহ। ১৮ বছরে বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন ৫০ শতাংশ অভিভাবক। পড়াশোনায় থাকা অবস্থায় মেয়েদের বেশি বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বেশি মেয়ে সন্তান থাকা পরিবারের চেয়ে একটি মেয়েসন্তান থাকা পরিবার বাল্যবিবাহ বেশি দিচ্ছে।

‘বর্ন টু বি আ ব্রাইড’ (কনে হওয়ার জন্যই যেন জন্ম) শিরোনামে জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ব্র্যাকের সোশ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল প্রোটেকশন (সেলপ) কর্মসূচি। বাল্যবিবাহের প্রবণতা ও কারণ খুঁজে বের করতে এ বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে দেশের ২৭টি জেলার ২ হাজার ৮০ গ্রামের ৫০ হাজার পরিবারের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সী। ৭০ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে।

বাল্যবিবাহের পেছনে ‘উপযুক্ত পাত্র’ পাওয়া, নিরাপত্তাবোধের অভাব ও দারিদ্র্য—একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। অভিভাবকেরা মেয়েটিকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে অন্যের ওপর দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চান।
বাল্যবিবাহ নিয়ে গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহ্‌নাজ হুদা

ব্র্যাকের সেলপ কর্মসূচির প্রধান ও ইনচার্জ শাশ্বতী বিপ্লব প্রথম আলোকে বলেন, জরিপে বাল্যবিবাহের কারণ নিয়ে যেসব ধারণা প্রচলিত আছে, এর বাইরে অন্য কারণগুলো বেশি পাওয়া গেছে। অভিভাবকদের বাল্যবিবাহ দেওয়ার মানসিকতার পাশাপাশি সামাজিক চাপ থেকেও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, এলাকার জনপ্রতিনিধি, কাজি, ইমামসহ লোকজনকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে সরকারকে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাল্যবিবাহের হারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম, এশিয়ায় প্রথম।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে বা বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ।

জরিপ হওয়া ২৭টি জেলার মধ্যে পিরোজপুরে সবচেয়ে বেশি—প্রায় ৭৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এরপরের অবস্থানেই রয়েছে চাঁপাইনবাগঞ্জে ৬৫ শতাংশের বেশি, নওগাঁয় ৬৫ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় ৬৩ শতাংশ এবং জয়পুরহাটে ৬১ শতাংশের বেশি।

পিরোজপুরে বেশি ও নেত্রকোনায় কম বাল্যবিবাহ

জরিপ হওয়া ২৭টি জেলার মধ্যে পিরোজপুরে সবচেয়ে বেশি—প্রায় ৭৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এরপরের অবস্থানেই রয়েছে চাঁপাইনবাগঞ্জে ৬৫ শতাংশের বেশি, নওগাঁয় ৬৫ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় ৬৩ শতাংশ এবং জয়পুরহাটে ৬১ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে কম বাল্যবিবাহ হওয়া পাঁচটি জেলা হচ্ছে নেত্রকোনা (২৪ শতাংশ), মৌলভীবাজার (২৯ শতাংশ), বাগেরহাট (২৯ শতাংশের বেশি), ময়মনসিংহ (প্রায় ৩০ শতাংশ) এবং মানিকগঞ্জ (৩২ শতাংশের বেশি)।

বাল্যবিবাহের কারণ

জরিপ অনুসারে, বাল্যবিবাহ দেওয়ার পেছনে পরিবারগুলো প্রধান তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক—৪৪ শতাংশ বলেছে ‘উপযুক্ত’ পাত্র পাওয়ায় বিয়ে দিয়েছে। এর বাইরে দারিদ্র্য, কম বয়সে বিয়ে দিলে বরপক্ষের যৌতুকের চাহিদা না থাকা বা কম থাকা, সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাব, মেয়ে পড়াশোনায় ভালো না হওয়া ইত্যাদি কারণের কথা বলেছেন অভিভাবকেরা।

১৮ বছরের আগে নাকি পরে—মেয়েদের কখন বিয়ে হওয়া উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে অভিভাবকদের ৫০ শতাংশ বাল্যবিবাহের পক্ষে এবং ৫০ শতাংশ বিপক্ষে মত দিয়েছেন। পক্ষে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগ বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। তবে বিরুদ্ধে হয়েও বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন, এমন পরিবার পাওয়া গেছে ১৮ শতাংশ।

সবচেয়ে কম বাল্যবিবাহ হওয়া পাঁচটি জেলা হচ্ছে নেত্রকোনা (২৪ শতাংশ), মৌলভীবাজার (২৯ শতাংশ), বাগেরহাট (২৯ শতাংশের বেশি), ময়মনসিংহ (প্রায় ৩০ শতাংশ) এবং মানিকগঞ্জ (৩২ শতাংশের বেশি)।

পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার ৩ নম্বর কাউখালী সদর ইউনিয়নের নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় এক ছাত্রীর (১৫) বিয়ে হয় গত বছর। মেয়েটির মা গতকাল মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, দারিদ্র্যের কারণে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েকে কম বয়সে বিয়ে দিয়েছেন, এটা নিয়ে তাঁর আফসোস নেই। তাঁর দুঃখ, শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেয়েকে একটু অত্যাচার করেন। প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের কেউ বিয়ে আটকাতে আসেননি বলে তিনি জানান।

ওই ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ঝর্ণা রানী প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে নিবন্ধন না করে গোপনে বিয়ে দেন। তাঁর দাবি, অনেক মেয়ে মুঠোফোন নিয়ে পড়ে থাকে, পালিয়ে বিয়ে করে—এ কারণে ভয়ে মা–বাবা বিয়ে দিয়ে দেন।  

মাধ্যমিকের মেয়েরা ঝুঁকিতে বেশি

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করার দ্বার প্রান্তে চলে আসা মেয়েরা সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। ১৬–১৭ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৬৩ শতাংশের বেশি। স্কুল থেকে ঝরে পড়া মেয়েদের চেয়ে পড়াশোনায় থাকা অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয়েছে—এ হার ৫৬ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ হওয়া মেয়েদের কেউ ৬ মাস, কেউ ১ থেকে ৭ বছরের বেশি সময় স্কুলে পড়েছে, কেউ কখনোই স্কুলে পড়েনি।

ধনী–দরিদ্র সব পরিবারেই বাল্যবিবাহ বেশি

বাল্যবিবাহের পেছনে দারিদ্র্যকে বড় কারণ বলা হলেও জরিপে উঠে এসেছে ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারেও বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশের ওপরে। পরিবারের আয় বেশি–কম হওয়ায় এখানে তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না। যে পরিবারের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা এবং যে পরিবারের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার বেশি, সেই পরিবারের বাল্যবিবাহের হার প্রায় একই—যথাক্রমে ৫৪ শতাংশ ও ৫৫ শতাংশ। আর এর মাঝামাঝি আয়ের পরিবারে বাল্যবিবাহের হার আরও বেশি—৫৮ শতাংশ।

এক দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে একমাত্র মেয়েটি সবার ছোট। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় দুই মাস আগে মেয়েটির বিয়ে হয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর মা-মেয়ের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলায় তাঁদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। মা বললেন, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়লেও মেয়ের বয়স ১৫-১৬ বছর। চার আনা সোনার দুল, বরের জন্য উপহার, লোকজন খাওয়াতে বিয়েতে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, যে পরিবারে একটিমাত্র মেয়ে, সেখানে বাল্যবিবাহের হার অস্বাভাবিক হারে বেশি—৮৯ শতাংশ। হিন্দু মেয়েদের তুলনায় মুসলিম মেয়েদের বাল্যবিবাহ বেশি হচ্ছে। বেশি শিক্ষিত অভিভাবকের চেয়ে কম শিক্ষিত অভিভাবকেরা বাল্যবিবাহ বেশি দিচ্ছেন।

২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, ২০২১ সালে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের হার এক-তৃতীয়াংশ কমানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল করার লক্ষ্য রয়েছে।

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাকিলা পারভীন বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক অনেক কার্যক্রম চলছে। বাল্যবিবাহের খবর পেলেই প্রশাসন থেকে প্রতিরোধ করা হয়।

বাল্যবিবাহ নিয়ে গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহ্‌নাজ হুদা প্রথম আলোকে বলেন, বাল্যবিবাহের পেছনে ‘উপযুক্ত পাত্র’ পাওয়া, নিরাপত্তাবোধের অভাব ও দারিদ্র্য—একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। অভিভাবকেরা মেয়েটিকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে অন্যের ওপর দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চান। কম বয়সী মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও নির্যাতনের শিকার হন। তিনি বলেন, বিশেষ বিধান বাল্যবিবাহ নিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা দিচ্ছে।

তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সমাজকে মেয়েদের জন্য নিরাপদ করার দায়িত্ব সরকারের। মেয়েদের শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম করতে হবে, যাতে পরিবারে ছেলেসন্তানের মতো সে–ও অগ্রাধিকার পায়।

প্রসঙ্গত, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭–এর ১৯ ধারায় বিশেষ বিধান অনুসারে, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবা কিংবা অভিভাবকের সম্মতিতে বিধি অনুসরণ করলে সেই বিয়ে বাল্যবিবাহের অপরাধ বলে গণ্য হবে না।