প্রকল্পের আওতায় এক হাজার পাঠাগারের কর্নারের জন্য কেনা হয় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই।
বাংলা একাডেমির ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ ছিল ড. এনামুল হক ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাঠাগারের সামনে। জাতীয় জাদুঘরে এই কর্নার ছিল তৃতীয় তলায় অবস্থিত সংগ্রহশালায়। দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ১৮টি প্রতিষ্ঠান ও দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানের শাখাগুলোতে তৈরি করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার।
মুজিব বর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে শুরু হয় এই কর্নার তৈরির কাজ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের বার্ষিক বরাদ্দ থেকে এ কাজে ব্যয় করে। তবে দেশের এক হাজার সরকারি-বেসরকারি পাঠাগারে কর্নার তৈরিতে দুই বছরের প্রকল্প নিয়েছিল গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই অধিদপ্তরের প্রকল্প চলে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পে খরচ হয় ২২ কোটি ২৪ লাখ টাকার বেশি অর্থ।
নানান সুবিধা আদায় করতে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই লিখেছেন। স্বাভাবিকভাবেই জনগণের করের টাকায় করা বঙ্গবন্ধু কর্নারের প্রকল্প হয়েছে অর্থহীন।অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রাবন্ধিক, লেখক ও সমাজ বিশ্লেষক
এই প্রকল্পের আওতায় ৭১টি সরকারিসহ দেশের এক হাজার পাঠাগারের কর্নারের জন্য কেনা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, তাঁর লেখা বই, তাঁকে নিয়ে লেখা বই এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইগুলো। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের কাছ থেকে এ জন্য ২৫০টি করে বই ও বই রাখার তাক পায়। তবে এই প্রকল্প গ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, বই কিনতে গ্রন্থাগারগুলোকে অর্থ দিয়ে দেওয়া হবে।
বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন নিয়ে ৩০৫৩ দিন, অমর শেখ রাসেল, ছোটদের বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিব আমার পিতা, বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অথবা শেখ হাসিনার নির্বাচিত উক্তি—এমন শিরোনামের বইগুলো দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের জন্য।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশের সব প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। বেশির ভাগ স্থানে এই কর্নারের বইগুলো রাখা আছে গুদামে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে রাখা হয়েছে পাঠাগারের অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে। দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পাঠাগারের কর্তৃপক্ষ বলছে, এই কর্নার স্থাপনে তারা ওপর থেকে নির্দেশনা পেয়েছিল।
জানতে চাইলে সংস্কৃতিসচিব (রুটিন দায়িত্ব) আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সব প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার করা হয়েছিল কি না, কত টাকা খরচ হয়েছে, এ ছাড়া আর কোন কোন খাতে দুর্নীতি থাকতে পারে—সেসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে খরচের বিষয়টি জানতে চাওয়া হবে। এরপর সামগ্রিক খরচের ধারণা পাওয়া যাবে।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন-কর্ম সম্পাদিত বই সরবরাহের মাধ্যমে পাঠক, গবেষক, তথ্য আহরণকারী ব্যক্তিবর্গসহ সর্বসাধারণের কাছে গ্রন্থাগারের ভূমিকাকে আরও অধিক আকর্ষণীয় ও কার্যোপযোগী করে তোলা।’ দেশের বিভিন্ন কারাগারের ভেতর থাকা পাঠাগারেও বানানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার।
গাজীপুরের সরকারি পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক মো. সালাউদ্দিন জানান, তাঁদের পাঠাগারের জন্যও বই ও আসবাব পাঠানো হয়েছিল। পরিবহন ব্যয় দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে তাঁদের হাতে কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি। খুলনার উমেশচন্দ্র পাঠাগারটি বেসরকারি। শতবর্ষী এই পাঠাগারের তত্ত্বাবধায়ক শ্যামল দেবনাথ বলেন, বঙ্গবন্ধু কর্নার তৈরির জন্য মোট ২৩৪টি বই এবং বই রাখার তাক পেয়েছিলেন তাঁরা। শেরপুর জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারী গ্রন্থাগারিক আবু হাশেম প্রথম আলোকে জানান, বঙ্গবন্ধু কর্নারের বই এখন সরিয়ে রাখা হয়েছে। প্রায় আড়াই শ বই তাঁরা পেয়েছিলেন। ফরিদপুরের ময়েজউদ্দিন জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের দীর্ঘদিনের গ্রন্থাগারিক ছিলেন মির্জা সাইফুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঠাগারগুলোতে বই দেওয়া হয়েছিল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায়। পাঠকের চাহিদা বা আমাদের দেওয়া তালিকা থেকে নয়।’
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন মোছা. মরিয়ম বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল দুই বছরের জন্য। ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের মেয়াদি এ প্রকল্পে ৭১টি সরকারি পাঠাগারসহ দেশের প্রায় এক হাজার পাঠাগারে এই কর্নার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন কারাগারে থাকা পাঠাগারগুলোও আছে। প্রকল্পের খরচ ছিল ২২ কোটি টাকার কিছু বেশি।
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর ছাড়াও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার বানিয়েছিল। বাংলা একাডেমি তাদের কর্নার বানিয়েছিল প্রায় ৪০০ বই দিয়ে। এর মধ্যে অন্তত ৯৭টি বই তাদের নিজস্ব প্রকাশনা। এসব বই এখন গুদামে সরিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান বাংলা একাডেমির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
একইভাবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কোনো প্রকল্পের আওতায় বা মন্ত্রণালয় থেকে এই কর্নার তারা করেনি। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার স্থাপনের সিদ্ধান্তের পর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ব্যয় থেকে এটি তৈরি করা হয়েছিল। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর তারা বইগুলো সরিয়ে নিয়েছে। তবে এ বাবদ কত খরচ হয়েছে, এমন কোনো হিসাব তারা দিতে পারেনি।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রাবন্ধিক, লেখক ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, নানান সুবিধা আদায় করতে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই লিখেছেন। যেখানে তাঁর জীবন ও কর্মের সঠিক প্রতিফলন হননি। এর ফলে কোনো নতুন সৃষ্টিশীল লেখকও তৈরি হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই জনগণের করের টাকায় করা বঙ্গবন্ধু কর্নারের প্রকল্প হয়েছে অর্থহীন।