ঠাকুরগাঁও-৩

শরিক দলকে ছাড় দিতে নারাজ আওয়ামী লীগ

ঠাকুরগাঁও-৩ সংসদীয় আসনে (পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈল উপজেলার আংশিক) গত চারটি নির্বাচনে কখনো জোট-মহাজোটে, কখনো মহাজোটের শরিক দলের মধ্যে, আবার কখনো মহাজোটের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর লড়াই হয়েছে। মহাজোটের হিসাব–নিকাশে পড়ে ২০০১ সাল থেকে সেখানে দলের কোনো প্রার্থী পাননি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ক্ষোভের শেষ নেই।

তবে এবার আর শরিকদের ছাড় দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, আসনটি বারবার শরিকদের ছেড়ে দেওয়ায় বঞ্চিত হয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। এবার সেই বঞ্চনার অবসান চান তাঁরা। এবারের নির্বাচনে এ আসন অন্য কোনো দলকে ছাড় দেওয়া হলে তৃণমূলে আবারও বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈল উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী আছে। এখানে সাংগঠনের ভিত্তিও বেশ মজবুত। ১৯৯১ সালে মোকলেসুর রহমান ও ১৯৯৬ সালে জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহসভাপতি ইমদাদুল হক দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

এরপর ২০০১ ও ২০০৮ সালে মহাজোটের মনোনয়ন পেয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে শরিক দলের মধ্যে উন্মুক্ত করে দেওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ইয়াসিন আলী জয়ী হন। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির ইয়াসিন আলীকে মহাজোট থেকে প্রার্থী করা হয়। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সেই অসন্তোষ থেকে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইমদাদুল হক।

এ সুযোগে পীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাহিদুর রহমান জয়ী হন। তিনি গত বছরের ডিসেম্বরে দলের সিদ্ধান্তে পদত্যাগ করেন। জাহিদুর রহমানের ছেড়ে দেওয়া আসনের উপনির্বাচনে আবারও মহাজোটের প্রার্থী হন ইয়াসিন আলী। এবার তিনি জামানত হারান। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ।

এ আসনে দীর্ঘদিন দলীয় সংসদ সদস্য না থাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এবার অসন্তোষ আরও বড় দানা বেঁধেছে। সম্প্রতি রানীশংকৈল উপজেলার শিবদীঘি এলাকায় সমাবেশ ডাকেন এলাকাবাসী। সেই সমাবেশে ইমদাদুল হককে প্রধান অতিথি করা হয়। সমাবেশে বক্তারা এই আসনে আওয়ামী লীগের বঞ্চনার কাহিনি তুলে ধরে বলেন, এই আসনের আওয়ামী লীগপ্রেমী মানুষ এখন অবহেলিত। এর পেছনের কারণ, দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকাবাসী পায়নি। এতে হতাশা বেড়েছে।

উপস্থিত নেতা-কর্মীরা আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ইমদাদুল হককে দলের মনোনয়নের জন্য আবেদন করার পরামর্শ দেন। আর মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে অনুরোধ করেন। জবাবে ইমদাদুল হক তাঁদের বলেন, ‘পরিস্থিতিই বলে দেবে আমাদের কী করতে হবে।’

এ বিষয়ে পীরগঞ্জ পৌর শহরের যুবলীগ কর্মী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘দুই দশক হয়ে গেছে, আমরা নৌকা প্রতীকে দলীয় কোনো নেতাকে ভোট দিতে পারিনি। আমরা ভোট দিয়ে যাঁদের এমপি বানিয়েছি, তাঁরা আর আমাদের দিকে তাকাননি। এতে কর্মীরা ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আর এর সুযোগ নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। তাই এবার আর ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।’

রানীশংকৈল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা বলেন, ‘আসনটি জেলার মধ্যে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ভালো। তবে বারবার বঞ্চিত হওয়ায় নেতা-কর্মীরা দলবিমুখ হয়ে পড়ছেন। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ–অধ্যুষিত এলাকাগুলোর উন্নয়ন হচ্ছে না। ফলে, আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছি। এবার দলীয় কোনো নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া না হলে গত নির্বাচনে যেমন ফলাফল হয়েছিল, এবারও তেমন হওয়ার আশঙ্কা দেখছি।’

রানীশংকৈল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সইদুল হক বলেন, ‘আমরা এবার এ আসনে নৌকা মার্কারই (আওয়ামী লীগের) প্রার্থী চাই। এভাবে চলতে থাকলে দল ক্ষতির মুখে পড়বে। আমরা অন্তত এবার আশা করছি, আমাদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। শরিক দলের কোনো প্রার্থীকে নৌকা মার্কা দেওয়া হলে এলাকার মানুষ মানবে কেন?’

জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি এখানে জিতলেও তার পেছনে ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থন। আমাদের নেতা-কর্মীরাই দিনরাত পরিশ্রমে করে তাঁর বিজয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে, পরের নির্বাচনে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে। এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা আর ছাড় দিতে চাইছেন না।’

২০০৮ ও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ইমদাদুল হক আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলেও জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার কারণে তাঁকে আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। ইমদাদুল হক বলেন, ‘২২ বছর ধরে এই আসনে দলের সংসদ সদস্য নেই। এবার দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া না হলে নেতা-কর্মীরা কী ঘটাবে, তা অনুমান করা যাচ্ছে না। নেতা-কর্মীরা দল থেকে মানসিকভাবে পদত্যাগ করবে। সেটা যে দলের কতটা ক্ষতি করবে, কেউ বুঝছেন না। আর যাদের আসনটি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের পাঁচ হাজার ভোটও নেই। এবারও তাদের ছেড়ে দেওয়া হলে মহাজোট আসনটি হারানোর আশঙ্কায় থাকবে।’

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে দলের অন্তত ১০ জন নেতা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইমদাদুল হক, সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ানুল হক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায়, সহসভাপতি ও পীরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আখতারুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান, রানীশংকৈল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সইদুল হক, রানীশংকৈল উপজেলা চেয়ারম্যান শাহরিয়ার আজম, রানীশংকৈল পৌরসভার মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান, রানীশংকৈল উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ ও উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য রবিউল ইসলাম।