কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হলেই ঠিকাদারের বিল। কিন্তু যেনতেনভাবে কাজ করেও বিল পেয়েছে ঠিকাদার।
প্রকল্পের কাজে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পুরো কাজ বন্ধ রাখার কথা বলেছে এডিবি।
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজের সময় কংক্রিটের গার্ডারচাপায় দুই শিশুসহ পাঁচজনের প্রাণহানি হলো। সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হলো। কিন্তু এ কাজে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা কেউ দায় নিচ্ছেন না। ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে সরকার শুধু দায় পেয়েছে ঠিকাদারের।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, তদন্তের যে গতিপথ, তাতে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়ী করার সম্ভাবনা কম। ঠিকাদারকে জরিমানা আরোপ করে দায় সারতে পারে সরকার। কারণ, তদন্ত কমিটির প্রধান নীলিমা আক্তার সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। তিনি বিআরটি প্রকল্পেরও সমন্বয়ক।
প্রকল্পের নির্মাণকাজ হচ্ছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, সেতু বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধানে। প্রতিটি সংস্থার আলাদা প্রকল্প পরিচালকসহ বাস্তবায়ন ইউনিট রয়েছে। তাদের মধ্যে সমন্বয় ও তদারকির জন্য নীলিমা আক্তারের নেতৃত্বে আছে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইউনিট।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের করা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির বাকি দুজন হলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা, অন্যজন সওজের কর্মকর্তা। কমিটি গতকাল মঙ্গলবার প্রাথমিক প্রতিবেদন দেয়। এতে কোনো কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়নি। সব দায় চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গেজহুবা গ্রুপের ওপর চাপানো হয়েছে। অবশ্য তদন্ত কমিটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে আরও দুই দিন সময় চেয়েছে।
গাড়িতে গার্ডার চাপা দেওয়ার ঘটনার পর গতকাল বিকেলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে এই প্রকল্পে মূল অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর। আগারগাঁওয়ের এডিবি কার্যালয়ে এ বৈঠক হয়। এ সময় প্রকল্পের কাজে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পুরো কাজ বন্ধ রাখার কথা বলেছে এডিবি। এ পরিস্থিতিতে কাজ অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গত সোমবার বিকেলে রাজধানীর উত্তরায় একটি প্রাইভেট কারের ওপর বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ে। এতে গাড়িতে থাকা পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
গার্ডার চাপা পড়ার ঘটনা ঘটেছে সওজের অংশের কাজে। গতকাল সওজ, সেতু বিভাগ ও এলজিইডি—এই তিন সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা উত্তরার ঘটনার আগের ও পরের অব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ করে বলছেন, ঠিকাদার, প্রকল্প কর্মকর্তা এবং পরামর্শক—সবারই এতে দায় আছে। ব্যস্ত সড়কে এভাবে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে কাজ চালানো হত্যাকাণ্ডের পর্যায়ে পড়ে। নির্মাণকাজে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা (সেফটি ও সিকিউরিটি) নিশ্চিতে দুই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথমত, কাজ শুরুর আগে এবং চলাকালে। দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনা ঘটে গেলে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এর কোনোটাই নেই বিআরটি প্রকল্পে।
বিআরটি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা এএফডি, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি নামের একটি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকার। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক এই প্রকল্প ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কাজ করার সময় ক্রেন ও গার্ডার নড়াচড়ার জন্য যতটুকু জায়গা দরকার, তা ঘিরে রাখার কথা ছিল। এই প্রকল্পের শুরু থেকে এমন কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি। কাজ চলার সময় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে আলাদা নিরাপত্তা দল থাকে। এ জন্য ঠিকাদারকে অর্থ দেওয়া হয়। কিন্তু ঘটনাস্থলে কাউকে বাঁশি কিংবা লাল পতাকা হাতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়নি। এমনকি নির্মাণকাজ চলাকালে কী পরিমাণ শব্দ সৃষ্টি করে, সেটি মাপার যন্ত্রও ব্যবহার করার কথা। বিআরটি প্রকল্পে তা ছিল না। বিদ্যমান সড়কের ভাঙাচোরা মেরামত করার দায়িত্ব থাকলেও সেটা করেনি ঠিকাদার।
গার্ডারচাপায় পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে ঠিকাদার দায়ী। কিন্তু প্রকল্প সমন্বয়কের নেতৃত্বে তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন।
নির্মাণকাজে কোন কোন ক্রেন এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে এবং এর চালক কারা থাকবেন—এর বিস্তারিত তথ্য ঠিকাদারের পক্ষ থেকে আগেই জমা দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু ঘটনার পর ক্রেনটির সক্ষমতা ও গার্ডারের ওজন কত, ক্রেনের চালক কে এবং তাঁর যথাযথ লাইসেন্স আছে কি না—এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পায়নি তদন্ত কমিটি।
গতকাল সচিবালয়ে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, প্রাথমিকভাবে ঠিকাদারের দায় পাওয়া গেছে। ক্রেনের চালককে খোঁজা হচ্ছে। ধরা পড়লে আরও অনেক কিছু জানা যাবে।
সড়ক বিভাগের সচিব বলেন, সোমবার জাতীয় শোক দিবসের সরকারি ছুটির কারণে পরামর্শক ও সওজের কর্মকর্তারা ছুটিতে ছিলেন। প্রকল্প পরিচালকসহ সওজের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গেই দিনভর শোক দিবসের নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, গার্ডার তোলার মতো কাজ করতে হলে আগের দিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান একটা কর্মপরিকল্পনা দেয়। কিন্তু ঠিকাদার তা পরামর্শক ও প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে জানায়নি। এ জন্য তাঁরা কর্মপরিকল্পনা পাননি। ঠিকাদার নিজের মতো কাজ করেছে। এমনকি পুলিশকেও জানানো হয়নি। ফলে প্রাথমিকভাবে ঠিকাদারকে দায়ী করা হয়েছে।
সচিব আরও বলেন, ঠিকাদারের চুক্তি বাতিল, জরিমানা আদায় এবং কালো তালিকাভুক্ত করার সুযোগ আছে। চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন পেলে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
তাহলে কি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কোনো দায় নেই—এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, আজই (গতকাল) প্রকল্প কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। তদন্তে দোষ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে গত ১৫ জুলাই গাজীপুর শহরে বিআরটি প্রকল্পের গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে একজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। গত বছরের ১৪ মার্চ বিমানবন্দর এলাকায় এবং আবদুল্লাহপুরে একই দিনে দুবার গার্ডারধসের ঘটনা ঘটে। এতে নির্মাণকাজে যুক্ত ছয়জন আহত হন। তাঁদের মধ্যে তিনজন চীনের নাগরিক ছিলেন।
বিআরটি প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগের ঘটনাগুলোর ঠিকমতো তদন্ত হয়নি। ঠিকাদার কিংবা কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে কাজ তদারক করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। বিআরটি প্রকল্পেও চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত আছে। ঠিকাদারের কাজ নিয়মমতো এবং মানসম্মত হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরামর্শক ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার। প্রতিটি কাজের শুরুতে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী কী নেওয়া হয়েছে, তা একটি লিখিত ফরমে উল্লেখ করতে হয়। এসব বিষয়ে পরামর্শক এবং প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হলেই ঠিকাদার বিল পাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগেও অরক্ষিত অবস্থায় বিআরটি প্রকল্পে কাজ চলেছে। সওজের অংশেই ৬০টি গার্ডার বসানো হয়েছে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই। এরপরও ঠিকাদার নিয়মিত বিল উঠিয়ে নিয়েছে।
সওজের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদার পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করবেই। তাদের কমপ্লায়েন্সে আনার দায়িত্ব পরামর্শক এবং প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। সেটা না করতে পারলে কাজের মান খারাপ হবে, দুর্ঘটনায় প্রাণ যাবে—এটাই স্বাভাবিক।
পর্যাপ্ত সুরক্ষাব্যবস্থা নেওয়ার পরও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ধরে নিয়ে পূর্বপ্রস্তুতি রাখার কথা চুক্তিতে আছে। কিন্তু সোমবার গাড়ির ওপর গার্ডার পড়ার পর প্রায় তিন ঘণ্টা সবাইকে অসহায় বসে থাকতে দেখা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, চাপা পড়া গাড়িতে শিশুসহ অন্যদের আর্তচিৎকার শোনা গেছে। কিন্তু ভারী গার্ডার না সরিয়ে তাঁদের বের করা যাচ্ছিল না। আরও আগে গার্ডার সরাতে পারলে হয়তো কেউ কেউ বেঁচে যেতে পারতেন।
গার্ডার চাপা পড়ার পরপরই ক্রেনচালক পালিয়ে যান। বিকল্প কোনো ক্রেন এবং চালক সেখানে ছিল না। ফলে গার্ডার সরানো যাচ্ছিল না। সড়ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মেট্রোরেল প্রকল্প, সেতু বিভাগের উড়ালসড়ক প্রকল্প এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে ক্রেন এবং চালক পেতে লেগে যায় প্রায় তিন ঘণ্টা। অবশ্য বিআরটি প্রকল্পের ক্রেনটি দিয়েই নতুন চালক গার্ডারটি সরিয়ে নেন।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এত বড় একটা কাজ ঠিকাদার নিজ ইচ্ছায় করে ফেলছে, আর কারও চোখে পড়ছে না—এটা অস্বাভাবিক। তাহলে পরামর্শক আর প্রকল্প কর্তৃপক্ষ থেকে লাভ কী? আসলে এভাবে ঠিকাদার অতীতে যেনতেনভাবে কাজ করে বিল পাওয়ায় উৎসাহিত হয়েছে।
এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘এত বড় একটা ঘটনার জন্য যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেটি বলা যায় নন-টেকনিক্যাল। অর্থাৎ তদন্ত কমিটি গঠনে গোড়ায় গলদ। এর মানে হচ্ছে কোনোরকমে একটা বলির পাঁঠা খোঁজা হচ্ছে। বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাবে। দেশে আরও বড় উন্নয়ন প্রকল্প হবে। এ ঘটনা থেকে যদি আমরা শিখতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে কড়া মাশুল দিতে হবে।’