এ বছর একুশে পা দিচ্ছে লন্ডন ডিজাইন ফেস্টিভ্যাল। দুই দশক পূর্তির এই আসরে বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের আমন্ত্রণে ডিজিটাল ডিজাইন উইকএন্ডে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান।
লন্ডন ডিজাইন ফেস্টিভ্যালের দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে লন্ডনের বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে আজ ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে জমকালো নকশা-উৎসব। তারই অংশ হিসেবে ডিজিটাল ডিজাইন উইকএন্ডে এই প্রথমবারের মতো থাকছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নকশার ভার্চ্যুয়াল উপস্থাপনা। ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের আমন্ত্রণে ২৩ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর যৌথভাবে অংশ নেবে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ‘ব্যুরো ফাইভ ফিফটি ফাইভ’ ও গবেষণাভিত্তিক আর্ট প্ল্যাটফর্ম ‘বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশন’।
নুসরাত ও তাঁর দল বিলুপ্তপ্রায় মৃৎশিল্প টেপাপুতুলকে ডিজিটাল ফেব্রিকের পোশাক পরালেন। সেটির স্কার্টের জমিনের নকশা করা হলো জামদানির মোটিফে। তাঁরা পুরো ডিজাইন উপস্থাপন করলেন অগমেন্টেড রিয়েলিটিতে।
উভয় প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা নুসরাত মাহমুদের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপে উঠে আসে তাঁদের ভার্চ্যুয়াল নকশাভাবনা, এর নেপথ্যের নানা খুঁটিনাটি এবং আমন্ত্রিত হওয়ার প্রক্রিয়া।
নুসরাত মাহমুদ জানান, অগমেন্টেড রিয়েলিটি ব্যবহার করে উপস্থাপন করা হবে ডিজিটাল কারু–দক্ষতা। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পকে ডিজিটাল মাধ্যমে উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও পরিবেশগত ভাবনার উদ্দীপনা জাগানোই এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মিলিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের পরম্পরা, প্রকৃতি, মানুষ ও প্রযুক্তির মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার ভাবনা এই প্রদর্শনীতে ফুটিয়ে তোলা হবে।
প্রতিষ্ঠান দুটির প্রতিনিধিত্ব করবেন এর দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা চিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী ও নুসরাত মাহমুদ, ব্যুরো ফাইভ ফিফটি ফাইভের আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা ফ্যাশন ও টেক্সটাইল ডিজাইনার গ্যাব্রিয়েল শাইনার-হিল এবং ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের শিক্ষক এ এফ এম মনিরুজ্জামান।
ডিজাইন উইকএন্ড শেষে এই প্রতিষ্ঠান দুটির তৈরি করা কিছু অগমেন্টেড রিয়েলিটি ক্যারেক্টার নিলামে তোলা হবে।
ডিজিটাল উপস্থাপনায় বাংলাদেশের কারুশিল্পকে তুলে ধরার পাশাপাশি কারুশিল্পের নকশাকে ডিজিটাল সম্পদে রূপান্তর করে পণ্য-নকশা ও পণ্য উন্নয়নে ব্যবহার করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর ফলে সাপ্লাই চেইনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব হবে।
এই আয়োজনে উপস্থিত দর্শকদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। তাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে হাতে-কলমে সত্যিকারের কাপড়ের ওপর জামদানি নকশার ব্লক প্রিন্ট করার জন্য। সেই নকশা ডিজিটাইজ করার পর দর্শকদেরই বলা হবে তাদের পছন্দের বস্তুর ওপর তা বসাতে, যা অগমেন্টেড রিয়েলিটির মাধ্যমে প্রদর্শন করা হবে। এভাবে ফ্যাশনের মাধ্যমে সত্যিকারের দুনিয়া ও ডিজিটাল জগতের মেলবন্ধন স্থাপনের পরিকল্পনা করা হবে।
ডিজাইন উইকএন্ড শেষে এই প্রতিষ্ঠান দুটির তৈরি করা কিছু অগমেন্টেড রিয়েলিটি ক্যারেক্টার নিলামে তোলা হবে।
ব্যুরো ফাইভ ফিফটি ফাইভের কার্যক্রম শুরু হয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এরই মধ্যে এমন আমন্ত্রণ এক অনন্য অর্জন। প্রতিষ্ঠার পরপরই এই স্টার্টআপ ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ইউনিভার্সিটি অব আর্টস, লন্ডনের কাছ থেকে অনুদান পায়। এ পর্যায়ে একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বিত নেটওয়ার্কের আওতায় আসে ব্যুরো ফাইভ ফিফটি ফাইভ। টেকসই ফ্যাশন, কারুশিল্পের যুগোপযোগী ব্যবহার, ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে সক্রিয়দের অনেকে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে আগ্রহী দেখান। বিলেতে ইতিবাচক প্রচারণাও চলে। এরপর ইউনিভার্সিটি অব আর্টস, লন্ডনের এক প্রতিনিধি তাদের জানান, ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম এ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী। এরপর মিউজিয়ামটি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায়, ‘ডিজিটাল ডিজাইন উইকএন্ডে’ তারা যোগ দিতে আগ্রহী কি না? এভাবেই এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের যাত্রা।
ডিজিটাইজ করা নকশাকে উপস্থাপন করে চমক লাগিয়ে দেওয়ার কাজটি সহজ ছিল না। বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনকে সঙ্গী করে বিশ্বজিৎ ও গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে বসে এ নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করেন নুসরাত। তাঁর মাথায় ছিল কয়েকটি বিষয়—বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে তুলে ধরা এবং সাপ্লাই চেইনে কার্বন নিঃসরণ কমানো। এ লক্ষ্যে তাঁরা কারুশিল্প ঐতিহ্যের ভিতের ওপরেই ডিজিটাল ফ্যাশনের কাঠামো তৈরি করে একে নবীন রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের মোটিফ হিসেবে জামদানিকে বেছে নেওয়া হয়। এরপর মোটিফগুলোকে কীভাবে ডিজিটাইজ করে অন্য কিছুর ওপরে বসানো যায় এবং যে কেউ নিজেই ডিজাইন করতে পারেন, তাঁরা সেই চ্যালেঞ্জটা নিলেন। এটিকে আকর্ষণীয় কোনো কিছুর ওপর বসিয়ে অগমেন্টেড রিয়েলিটিতে নিয়ে যাওয়াও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
নুসরাত ও তাঁর দল বিলুপ্তপ্রায় মৃৎশিল্প টেপাপুতুলকে ডিজিটাল ফেব্রিকের পোশাক পরালেন। সেটির স্কার্টের জমিনের নকশা করা হলো জামদানির মোটিফে। তাঁরা পুরো ডিজাইন উপস্থাপন করলেন অগমেন্টেড রিয়েলিটিতে। এমনভাবে সেটা করা হলো, যাতে প্রদর্শনীতে উপস্থিত সবাই অনায়াসে তা করতে পারেন এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটির আবহে নিজেরই নকশার পোশাক পরা টেপাপুতুলের সঙ্গে ছবিও তুলতে পারেন।
ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম বিলেতে চারু ও কারুশিল্পের অনুরাগীদের তীর্থস্থান। সেখানে রক্ষিত আছে এ দেশের হারিয়ে যাওয়া মসলিন এবং অনেক মহার্ঘ জামদানির নমুনা।
ব্যুরো ফাইভ ফিফটি ফাইভ ও বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনের এই সমন্বিত আয়োজন এ দেশের ডিজিটাল ফ্যাশনের বড় ঘটনা। কারণ, এর আগে বাংলাদেশের ফ্যাশনের কোনো প্রদর্শনীই এই জাদুঘরে হয়নি।