অর্থনীতিবিদ রেহানা তৌফিক (বাঁয়ে) বিপসের বক্তৃতা অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন। পাশে মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান
অর্থনীতিবিদ রেহানা তৌফিক (বাঁয়ে) বিপসের বক্তৃতা অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন। পাশে মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান

শ্রীলঙ্কা সংকটের শিক্ষা নিয়ে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনা জরুরি

শ্রীলঙ্কায় সরকারের ভুল অর্থনৈতিক নীতি, দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সুশাসনের ঘাটতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতাসহ নানা কারণে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার সংকট এ অঞ্চলের সবার জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। সংকট উত্তরণে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে ধাপে ধাপে যথাযথ পরিবর্তন আনা জরুরি।

রাজধানীর একটি হোটেলে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে গত শনিবার সন্ধ্যায় এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে দেশটির তরুণ অর্থনীতিবদ রেহানা তৌফিক এ অভিমত দিয়েছেন।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস) ‘শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট: এই অঞ্চলের জন্য শিক্ষণীয়’ শীর্ষক ওই বক্তৃতার আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও বিআইপিএসএসের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান। এরপর আমন্ত্রিত বক্তা রেহানা তৌফিক প্রায় ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের কারণ এবং এর পূর্বাপর পরিস্থিতি ও উত্তরণ নিয়ে কথা বলেন। এরপর তিনি আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রশ্নের উত্তর দেন।

রেহানা তৌফিক বলেন, অর্থনৈতিক সংকট থেকে শ্রীলঙ্কার উত্তরণ হবে ধাপে ধাপে। সংকটের উৎস কোথায়, তা নিয়ে কথা বলেন তিনি। সংকটের কারণ হিসেবে তিনি ২০১৯ সালে ইস্টার সানডের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, কোভিড-১৯, কাঠামোগত অসুবিধার কারণে পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে ধাক্কা, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাওয়া, সরকারের ত্রুটিপূর্ণ নীতির কথা উল্লেখ করেন। সব অসংগতি সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা প্যাকেজ নিয়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গতি ফিরতে শুরু করেছে। তিনি শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলির উদাহরণ টেনে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এ ধরনের সংকট উত্তরণে কিছু সুপারিশ করেন।

রেহানা তৌফিকের মতে, শ্রীলঙ্কার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতায় যাওয়ার পর একনায়ক হয়ে ওঠার কারণে সংকট ঘনীভূত হয়। কারণ, রাজনীতিবিদেরা তাঁদের বাজে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার আগে কোনো রকম আলোচনা করেননি। এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কোনো ধরনের ভারসাম্য ছিল না। তিনি সংকটের জন্য সামগ্রিকভাবে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সংকট ও সংবিধান সংশোধনের মতো ধাক্কাকেও দায়ী করেন।

হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর ও মাতাল্লা বিমানবন্দরের মতো বড় প্রকল্পগুলো অর্থনৈতিক সংকটে কতটা ভূমিকা রেখেছে জানতে চাইলে রেহানা তৌফিক বলেন, এ প্রকল্পগুলো শ্রীলঙ্কার বৃহৎ সংকটের একটি ক্ষুদ্র অংশ। তবে অনিবার্যভাবে এ প্রকল্পগুলো একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার সত্যিকারের প্রতিফলন। এ ধরনের প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই একটি গোষ্ঠীর অযাচিতভাবে চাপিয়ে দেওয়া বলে অভিযোগ আছে। সরকার আসলেই এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে চায়নি। কিন্তু কিছু বিনিয়োগকারী এসব প্রস্তাব নিয়ে এসে বলেছে—‘আমরা এই ঋণ দেব, প্রকল্পগুলো করুন’। আর এটাই সমস্যার মূলে যে দুর্নীতি, সেটা তুলে ধরছে।

রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া প্রশাসকেরাও শ্রীলঙ্কার সংকটের জন্য দায়ী বলে মনে করেন রেহানা তৌফিক। তিনি বলেন, বড় বড় অনেক প্রকল্প নেওয়ার সময় জনগণের প্রয়োজনকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের স্বার্থকেই বড় করে দেখা হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কলম্বো থেকে গল পর্যন্ত যে এক্সপ্রেসওয়ে করা হয়েছে, এর সুফল তো সাধারণ জনগণ পাবে না। অথচ সরকার গণপরিবহনে বিনিয়োগ করেনি। ব্রিটিশের রেখে যাওয়া রেলওয়ে খাতে সংস্কার আনেনি। অর্থাৎ সরকার আর রাজনীতিবিদেরা কোটি কোটি রুপি খরচ করেছেন ধনীদের জন্য, যার সুফল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পায়নি।