বিবিসির প্রতিবেদন

‘ভাত না জোটার’ বক্তব্য প্রকাশ করে সাংবাদিক কারাগারে

বিবিসির প্রতিবেদনের একাংশের স্ক্রিনশট
বিবিসির প্রতিবেদনের একাংশের স্ক্রিনশট

খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্য নিয়ে প্রতিবেদন ভাইরাল হওয়ার পর বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদপত্রের একজন সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা’ সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়েছে।

শামসুজ্জামান শামস নামে দৈনিক প্রথম আলোর ওই সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের এক দিন পর আদালতে তোলা হয়। আদালত তাঁর জামিন নামঞ্জুর করেন।

২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসে শামসুজ্জামানের ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে ‘সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।

মানবাধিকারকর্মীরা শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের অভিযোগ এনেছেন।  

বাংলাদেশ সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করছে। তবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিরা ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ধারাবাহিকভাবে সংকুচিত হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে আসছেন।

বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডারস গত বছর বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৬২তম অবস্থানে রেখেছে। এই অবস্থান রাশিয়া ও আফগানিস্তানের চেয়ে নিচে।

শামসুজ্জামান যে পত্রিকায় কাজ করেন, সেটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী দৈনিক। শামসুজ্জামানকে কত দিন কারাগারে থাকতে হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এই প্রতিবেদকে বুধবার ভোররাতে ঢাকার বাইরে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান সাদাপোশাকে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা। প্রায় ৩০ ঘণ্টা ধরে তাঁর অবস্থান জানতে পারেনি প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ। কারণ, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছিল, শামসকে নিয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।

যে প্রতিবেদনের কারণে শামসকে আটক করা হয়েছে, তাতে স্বাধীনতা দিবসে জীবনযাত্রা নিয়ে সাধারণ বাংলাদেশিদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে প্রশ্নের জবাবে একজন দিনমজুর পাল্টা প্রশ্ন করে বলেছিল, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম।’

দিনমজুরের এই বক্তব্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাড়তে থাকা উদ্বেগের বিষয়টিই ফুটে ওঠে। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর থেকে বিশ্বজুড়েই খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে।

প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদন বিপুলসংখ্যক মানুষ শেয়ার করেন। যখন প্রতিবেদনটি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়, তখন তাতে ওই বক্তব্যের সঙ্গে আরেকজনের ছবি দেওয়া হয়।

সংবাদপত্রটির নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা যখন ভুলটা বুঝতে পেরেছিলাম, তখনই এটি সরিয়ে নিয়েছিলাম এবং প্রতিবেদনটির (সংশোধিত) নিচে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল প্রতিবেদন ঠিক ছিল। খাদ্যের দাম নিয়ে দিনমজুরের বক্তব্যটি সঠিক।’

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা পত্রিকাটির বিরুদ্ধে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ তুলেছেন।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ সংবাদমাধ্যমটির একজন ক্যামেরাম্যান এবং আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, অসন্তোষ তৈরির অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শামস প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, মামলাটি একজন ব্যক্তি করেছেন, সরকার নয়। আইন অনুযায়ী সব কিছু হবে।

আইনমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেদনটির জন্য দৈনিকটির সম্পাদক ও প্রকাশকেরও দায় রয়েছে এবং সে কারণে পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।

এমন সময় এ ঘটনা ঘটল, যখন আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মানবাধিকারকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হয়রানির অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

ঢাকায় কয়েকটি পশ্চিমা দেশের উদ্যোগে গড়ে তোলা দ্য মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন প্রথম আলোর সাংবাদিককে গ্রেপ্তারসহ সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা ও তাঁদের ভয়ভীতি দেখানোর সাম্প্রতিক খবরগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা বলছেন, সরকারের সমালোচনা হয় এমন প্রতিবেদন করতে গেলে চাপের মুখে পড়তে হয় এবং এই চাপ ক্রমশ বাড়ছে। তাঁরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে।

সংবাদমাধ্যমের অধিকার নিয়ে কাজ করা গ্রুপগুলো বলছে, ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের পর থেকে প্রায় ২৮০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করা হয়েছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আইনটির উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে সরকার সংবাদমাধ্যমগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। তিনি বলেন, ‘ভয় দূর করতে আমি তাঁদের (সম্পাদক) সঙ্গে কাজ করছি। আমরা আইনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন উন্নত করতে হয়, তাহলে আমরা তা করার জন্য বিধি তৈরি করব।’