বাদ পড়া ৫৬ জন ভোটের লড়াইয়ে

নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন কমিশনে আপিল নিষ্পত্তির প্রথম দিনে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ৫৬ জন। বাছাইয়ের সময় তাঁদের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা।যাঁরা প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৩৩ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাঁদের প্রায় সবার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল সমর্থনসূচক ১ শতাংশ ভোটারের সইয়ের গরমিলের কারণে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে গেলে নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর তালিকা জমা দিতে হয়।

গতকাল রোববার প্রথম দিন মোট ৯৪টি আপিল শুনেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়া দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আওয়ামী লীগের নাসিরুল ইসলাম খান, মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে (শ্রীনগর ও সিরাজদিখান উপজেলা) বিকল্পধারার মাহী বি চৌধুরী, পাবনা-২ (সুজানগর-বেড়া একাংশ) আসনে বিএনএমের ডলি সায়ন্তনী, বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেসের আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম প্রমুখ।

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে। এবার ৩০০ সংসদীয় আসনে ২ হাজার ৭১৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বাছাইয়ে ৭৩১টি মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইসিতে মোট ৫৫৮টি আপিল হয়েছে। গতকাল থেকে শুনানির মাধ্যমে আপিল নিষ্পত্তি শুরু হয়েছে, যা ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান শুনানি নেন। তবে এর আগের নির্বাচনে আপিল শুনানি উন্মুক্ত থাকলেও এবার তা ছিল না। আপিলের সময় সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। শুধু আপিলের সিদ্ধান্ত শুনানি কক্ষের বাইরে মনিটরে (বড় পর্দায়) দেখানো হয়।

প্রথম দিনে ৯৪টি আপিলের মধ্যে একটি ছিল একজন বৈধ প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের বৈধতার বিরুদ্ধে। বাকিরা আপিল করেছিলেন নিজ নিজ প্রার্থিতা ফিরে পেতে। এর মধ্যে ৫৬টি আপিল মঞ্জুর করে ইসি, ৩২টি নামঞ্জুর করা হয়। আর ছয়টি আপিলের শুনানি হলেও রায় হয়নি। এগুলোর রায় পরে ঘোষণা করা হবে।

দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে আপিলের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১ জন, জাতীয় পার্টির ৫ জন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৪ জন, তৃণমূল বিএনপির ৩ জন, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির ৩ জন, বিএনএফের ২ জন, বিএনএমের ২ জন, জাকের পার্টির ১ জন, বিকল্পধারার ১ জন ও ইসলামী ফ্রন্টের ১ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।

হলফনামায় মামলার তথ্য উল্লেখ না করায় কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাসিরুল ইসলাম খানের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা। গতকাল আপিলে নাসিরুল প্রার্থিতা ফিরে পান। তাঁর আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক।

ঋণের জামিনদার হিসেবে খেলাপি হওয়ায় মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে বিকল্পধারার প্রার্থী মাহী বি চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার পর মাহী বি চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ১৩ বছর আগে একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণের জামিনদার ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি (ঋণ তথ্য ব্যুরো) প্রতিবেদনে সেই প্রতিষ্ঠানের জামিনদার হিসেবে এখন তাঁর নাম উল্লেখ নেই।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে নেত্রকোনা-৫ আসনে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। প্রার্থিতার সমর্থনসূচক সইয়ের গরমিলের কারণে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছিল। তবে নেত্রকোনা-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শফী আহমেদের আপিল নামঞ্জুর হয়েছে। তাঁর প্রার্থিতা বাতিলই থাকছে।

প্রার্থিতা ফেরত পাওয়ার পর আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ইসির সিদ্ধান্তে তাঁর এলাকার ভোটাররা আনন্দিত। নির্বাচন হয়তো অংশগ্রহণমূলক হবে, কিন্তু ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন কি না, গোপনীয়তার মধ্যে তাঁদের ভোট দিতে পারবেন কি না, এটি এখনো চ্যালেঞ্জ।

‘ডামি ক্যান্ডিডেট’কে বের করে দেওয়ার অভিযোগ

আপিল শুনানি কক্ষের বাইরে মিডিয়া সেন্টারে এসে গতকাল দুপুরের দিকে টাঙ্গাইল-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী এ টি এম আনিছুর রহমান সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, শুনানির সময় তাঁর সঙ্গে অশোভন আচরণ করা হয়েছে। সিইসি তাঁকে পুলিশ দিয়ে বের করে দেওয়ার কথা বলেছেন।

নিজেকে আওয়ামী লীগের ‘ডামি ক্যান্ডিডেট’ জানিয়ে আনিছুর জানান, দুপুর (হতকাল) ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত ৪১ থেকে ৬০ নম্বর সিরিয়ালের আপিল শুনানি হওয়ার কথা ছিল। তাঁর সিরিয়াল নম্বর ছিল ৪৪। তবে ১২টার আগেই তাঁর আপিল শুনানি হয়ে যায়। যে কারণে তিনি শুনানি কক্ষে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তারপর শুনানি কক্ষে প্রবেশ করে কমিশনের উদ্দেশে তিনি বলেন, আধা ঘণ্টা আগে শুনানি হয় কীভাবে? শুনানি এগিয়ে নিয়ে আসার বিষয়টি তাঁকে জানানো হয়নি। কমিশন তাঁর সঙ্গে অন্যায় করেছে। আপিল শুনানির জন্য এত তাড়াহুড়া কেন—এ ধরনের বক্তব্যের পর সিইসি তাঁকে পুলিশ দিয়ে বের করে দিতে চান।

আনিছুর বলেন, ‘আমি বলেছি, মিস্টার আউয়াল (সিইসি), আপনি আমার বিভাগের ছাত্র। আমিও ল বিভাগের ছাত্র।’ আর পুলিশের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, সাবধান! আমি আগেই বের হয়ে যাব। ডোন্ট টাচ মি। তারপর আমি বের হয়ে এসেছি।’

অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাংগীর আলম গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোর্টের (আদালত) ডিসিপ্লিন (শৃঙ্খলা) নষ্ট করলে কোর্ট তো ডিসিশন দেবেই।’

সাদিক আবদুল্লাহর বিষয়ে রায় পরে

বরিশাল-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়নপত্রের বৈধতার বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। সাদিক আবদুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, সেখানে তাঁর স্ত্রীর নামে সম্পদ আছে, এসব তিনি গোপন করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়। গতকাল এ বিষয়ে শুনানি করে ইসি জানায়, সিদ্ধান্ত পরে জানানো হবে।

শুনানি শেষে সাদিক আবদুল্লাহর আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। কিন্তু যে কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে, সেখানে নাম লেখা আছে শেওয়াদ এস আবদুল্লাহ। তাঁর প্রার্থীর নাম সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। এ ছাড়া প্রার্থীর স্ত্রী লিপি আবদুল্লাহর নামে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি আছে, এমন কাগজপত্রের কপি দিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। তাঁরা শুনানিতে বলেছেন, এই কাগজের অথেনটিসিটি (সঠিকতা) নেই। পরে কমিশন বলেছে, এ বিষয়ে ইসি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে খোঁজ নেবে। রায় মঙ্গলবার জানানো হবে।

ঋণখেলাপি হওয়ায় কক্সবাজার-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমদের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। গতকাল তাঁর আপিলের শুনানি হয়। তবে ইসি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর বিষয়ে রায় ঘোষণা করেনি। তাঁর বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানাবে ইসি।