কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের হোয়াইক্যং বাজার থেকে আধা কিলোমিটার পুবে উত্তরপাড়া এলাকা। সেখান থেকে মিয়ানমার সীমান্ত দেখা যায়। দূরত্ব ৩০০ গজের মতো। এই উত্তরপাড়ায় যেখানে আজ শনিবার সকালে সীমান্তের ওপার মিয়ানমার থেকে গুলি এসে পড়েছে, সেখান থেকে ১০০ গজ পশ্চিমে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) সীমান্ত ফাঁড়ির অবস্থান।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উত্তরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায় লোকজনের জটলা। সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। তাঁরা বলাবলি করছেন, গুলির শব্দে তাঁদের ঘুম ভাঙে। এরপর ভোর পাঁচটা থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত চার ঘণ্টায় ওপার থেকে ‘বৃষ্টির মতো’ গুলি এসেছে। পুরোটা সময় কাটে তাঁদের আতঙ্কে।
তবে তখনো ভয়ে-আতঙ্কে অনেকের হাত-পা কাঁপছিল। আতঙ্কিত মানুষগুলো জানান, গুলি এসে পড়েছে দোকান, মাছের ঘের ও বসতবাড়িতে। তবে কেউ হতাহত হননি। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
উত্তরপাড়ার বাসিন্দা নূর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গুলির শব্দে ঘুম ভেঙেছে তাঁর। এরপর শুধু বৃষ্টির মতো গুলি এসেছে। এখন কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। পরিবার নিয়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
গত বুধবার রাত থেকে হোয়াইক্যং সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলি শুরু হয়। এরপর বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান ওই এলাকার লোকজন। কিন্তু আজ ভোর পাঁচটা থেকে গোলাগুলি শুরু হওয়ায় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যায়।
হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা খুরশিদা বেগমের চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক। এই প্রতিবেদককে আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, এখনো তাঁর হাত-পা কাঁপছে। আজকে মনে করেছিলেন মারা যাবেন! বেঁচে আছেন, সেটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না!
উত্তরপাড়ার মুদিদোকানদার নুরুল ইসলাম আজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দোকানের পেছনে দেয়ালে একটি গুলি লেগেছে। দেয়াল পাকা বলে গুলিটি ভেতরে ঢুকতে পারেনি। পরে প্রশাসনের লোকজন গুলিটি নিয়ে যায়। আবার কখন গুলি এসে পড়ে, সেই ভয়ে আছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াসের একটি মাছের ঘের রয়েছে। আজ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সকালে তাঁর মাছের ঘেরে একটি গুলি এসে পড়তে দেখেন। তাঁর পাশে মোহাম্মদ মানিকের ঘেরে অনেক গুলি পড়েছে।
২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ চলছে। এরই মধ্যে বিজিপিকে হটিয়ে তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। রোববার দিবাগত রাত তিনটা থেকে দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। পরদিন সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। এ ছাড়া মিয়ানমার সেনা, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য, শুল্ক কর্মকর্তাসহ ৩৩০ জন বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। তাঁরা বর্তমানে বিজিবি হেফাজতে রয়েছেন। আকাশ কিংবা নদীপথে তাঁদের সে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে।
শুধু সীমান্ত-লাগোয় উত্তরপাড়া নয়, সীমান্ত থেকে এক কিলোমিটার দূরে মাঝেরপাড়া এলাকায় মোহাম্মদ আফসারের ঘরে সকাল সাতটার দিকে জানালা দিয়ে একটি গুলি ঢুকে পড়ে। আফসার প্রথম আলোকে বলেন, তখন ঘরে সবাই ছিলেন। তবে কারও গায়ে গুলি লাগেনি।
আফসারের ঘর থেকে ৫০০ গজ পুবে দলু মিয়ার ঘরেও জানালা দিয়ে একটি গুলি ভেতরে এসে পড়ে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য সিরাজুল মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকালে বৃষ্টির মতো গুলির শব্দ শুনে ঘর থেকে একটু বের হই। আমার চোখের সামনে একটি গুলি উড়ে যায়। আজকে হয়তো আমার জানাজা পড়াতে হতো।’
উত্তরপাড়ায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি ফাঁড়ি রয়েছে উল্লেখ করে সিরাজুল মোস্তফা বলেন, বুধবার থেকে রাতে গোলাগুলি হলেও দিনে হতো না। কিন্তু শনিবার সকাল থেকে গোলাগুলি শুরু হওয়ায় এবং লোকজনের বসতবাড়িতে এসে পড়ায় সবাই চরম আতঙ্কে রয়েছে।
তবে এ ঘটনার পর ওই এলাকায় বিজিবির সদস্যরা পাহারা জোরদার করেছেন এবং সতর্ক অবস্থায় আছেন।